মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৩ পূর্বাহ্ন

ই-পেপার

জন্ম-কথা ; জন্ম তারিখের কথা

মাসুদ রানা, আটঘরিয়া(পাবনা) প্রতিনিধি:
আপডেট সময়: শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫১ অপরাহ্ণ

নব্বই দশকের কথা। একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান শ্রেণির প্রথম দিন জনৈক অধ্যাপক এক আজব প্রশ্ন করে বসলেন। ‘কার সত্যিকার জন্ম-তারিখের সাথে এস.এস.সি বা সমমান সনদে উল্লেখিত জন্ম-তারিখের মিল আছে’? প্রায় ছাপ্পান্নো জন ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে মাত্র একজন হাত তুলেছিল। প্রশ্নটা তখন আজব মনে হলেও বর্তমান অভিজ্ঞতায় মনে হয় যে এ যুগে দশ হাজারেও কেউ হাত তুলবে কি না সন্দেহ। অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রী নিজেরা, কিংবা স্কুলের শিক্ষকমন্ডলী-সবাই মিলে সত্যিকার জন্ম-তারিখটাকে (কারো কারো ক্ষেত্রে নামটাকেও) একটা প্রহসন হিসেবে ধরে নিয়ে মিথ্যা জন্ম-তারিখ বানানো এবং ব্যবহারের দারুন (নিদারুন) সংস্কৃতি তৈরি করে ফেলেছেন।

 

আমি আমার মা’কে অনেক বার মনে করানোর চেষ্টা করেছি যে আমার সত্যিকারের জন্ম-তারিখটা আসলে কবে। আমার ভাই-বোন কেই বলতে পারে না। আত্নীয়-স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী কেউই বলতে পারে না। কেউ মনে রাখেনি। মনে রাখার প্রয়োজন ও মনে করেনি। ওইদিন বিশেষ কিছু ঘটিছিল? হ্যাঁ, অনেক বৃষ্টি ছিল। বর্ষাকাল ছিল। আর কিছূ? কোন ঘটনা কিংবা অঘটন? হ্যাঁ, অমুকের নানী মারা গিয়েছিল। আমি দৌড়ালাম তাদের বাড়ি। সে বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষকে অনেক মনে করানোর চেষ্টা করলাম। সে বলল, মা বেঁচে থাকলে হয়ত বলতে পারত! কিন্তু আমার নানীর মৃত্যু-তারিখ তোমার কি কাজে লাগবে? আমি তাকে বোঝাতে পারিনি। আর উদ্ধার ও করতে পারিনি। কাহিনীটা তুরস্কের একজন বিখ্যাত লেখকের! রেডিও ‘ডয়েসে-ভেলে’র জার্মান ভাষা শেখার আসরে আমি এই গল্পটি শুনেছি। আমাদের দেশে এখন অবশ্য জন্ম-নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তবে সত্যিকার তারিখটা কোন কাজেই ব্যবহৃত হয় না।

 

আমার ধারনা আমাদের চারপাশে লাখো উদাহরণ আছে তার। খেয়াল করে দেখুন যাদের মাসের পয়লা তারিখে জন্ম হিসেবে জন্ম-তারিখ দেয়া আছে, এই তারিখটা তাদের নিজস্ব নয়; স্কুলের শিক্ষকদের দেয়া। ক্লাস নাইনে এস.এস.সি পরীক্ষার নিবন্ধন করা হয় (বর্তমানে পি.এস.সি পরীক্ষাতেও হচ্ছে)। ইদানিং দেখা যায় যে নিবন্ধনের আগে অনেকেই পুরোনো জন্ম-সনদ কাগজ-ওয়ালার কাছে বিক্রে করে দিয়ে পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে শিক্ষকদের দেয়া তারিখ অনুযায়ী নতুন সনদ নিচ্ছেন। সেখানে কিছু ক্ষেত্রে দিন-মাস না বদলালেও সাল দু-চার বছর পরের করে রাখা হচ্ছে। মানে দাঁড়ায় যে আপনার যখন চার বছর বয়স তখনই আপনার জন্ম হলো। এই যে মিথ্যাচার (!?) লাখো ছাত্র-ছাত্রীর (ভবিষ্যৎ নাগরিক) ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো সেটা তারা না বুঝেই বয়ে বেড়াবে সারা জীবন।

 

কোন এক স্কুলের/মাদ্রাসার মাধ্যমিক পরীক্ষার বিদায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে আমি বিষয়টা তুলেছিলাম। ভালো প্রতিক্রিয়া পেলাম। তাতে বিষয়টার সুন্দর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। শিক্ষকগণ প্রকারান্তরে উপকারই করছেন। সেশন-জট, পাশ-ফেইল, ইত্যাদি নানা কারনে শিক্ষার্থীদের চাকুরীর বয়স পেরিয়ে যায়। তারিখ বদলিয়ে বয়স কমিয়ে দিলে চাকুরীর চেষ্টার জন্য হলেও দুই-চার বছর বেশি সময় পাওয়া যাবে। আর সে কারনে বিষয়টা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। তালি পাবার মত বক্তব্য। তাতে বিশেষ চারটি পয়েন্ট পাওয়া যায়। এক, স্কুলের শিক্ষকরা যে কোন একটা বিষয়ে কাজ শুরু করলে বিপ্লব ঘটাতে পারেন সেটা প্রমাণিত। দুই, চাকরীর বয়স পেরিয়ে যাবার দায় শিক্ষকদের। তিন, আজকের কিশোর-কিশোরীরা আগামীতে সব্বাই-ই কেবল চাকরীই করবে। এবং চার, স্বার্থরক্ষায় যে কোন সত্যকে যে কোন সময় মিথ্যায় পরিণত করা অন্যায় নয়। প্রথমটা সবদিক দিয়ে সত্য হলেও বাকি তিনটারই কোন ভিত্তি নেই। শিক্ষকদের দায়িত্ব শিক্ষা দেয়ার। আর চাকরীর ক্ষেত্র তৈরী কিংবা চাকরীর বয়স সংক্রান্ত ব্যাপারে দায়িত্ব কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহনের দায়-দায়িত্ব সরকারের। তাছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল চাকরীই করবে এই অনুসিদ্ধান্ত ওদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলে দেশ বঞ্চিত হবে রাজনীতিবিদ, কবি, শিল্পী, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক কিংবা সৃষ্টিশীল পেশার নাগরিক থেকে। সে দায় কে নেবে? সবচেয়ে বড় কথা যে চতুর্থ পয়েন্টে যেটা বলা হয়েছে তাতে কেউই অন্যায়কে অন্যায় মনে করবে না। জন্ম-তারিখ যদি বদলানো যায়, বাবার নাম ও বদলানো যাবে, মিথ্যা বলে, ফাইল আটকে রেখে টাকাও নেয়া যাবে। একই কথা।

 

ভারতের এক জেনারেলের অবসর যাবার বয়স নিয়ে যে কাহিনী জানা গেল তা আমাদের দেশের হাজার হাজার চাকরীজীবির কপালেও তিলক হিসেবে খোদিত আছে। এসব চাকরীজীবির আসল বয়স হিসাব করলে দেখা যাবে যে তাদের দু-চার বছর আগেই অবসরে চলে যাওয়া উচিত অথচ কেবল বয়স চুরির কারনে অবসরের বয়স পেরিয়ে যাবার পরও তাঁরা চাকরী করে যাচ্ছেন। দেশের একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথা না বললেই নয়। তাঁর সার্টিফিকেটে এক জন্ম-তারিখ, বিয়ের কাবীন-নামায় আরেক রকম জন্ম-তারিখ। আসলে এতে তাঁর কোনো হাত ছিল না বলে আমার ধারনা। কারন, সার্টিফিকেটের যে জন্ম-তারিখ সেটার স্রষ্টা স্কুলের শিক্ষক (ধারনা থেকে বলা), আর কাবিন নামার জন্ম-তারিখ হতে পারে তাঁর ওয়াকিল বাবার দেয়া (বিয়ের সময় সাক্ষী ছাড়া এমন বাবা ও থাকেন)। জন্ম-তারিখ থেকে সৃষ্ট বিড়ম্বনায় তিনি যথেষ্ট নাজেহাল হওয়া সত্বেও এ বিষয়ে কোনে পদক্ষেপ নেননি। নিলে বহু মানুষ অনেক মানসিক ও প্রশাসনিক যাতনা থেকে রেহাই পেত।

 

আমাদের দেশে বয়স বলা কিংবা জিজ্ঞেস করা দুটোই কিভাবে লজ্জা আর শিষ্টতার (ধৃষ্টতা !) মধ্যে পড়ে আমার মাথায় আসে না। অনেককে দেখি জন্ম-তারিখের কথা বললে কেবল দিন আর মাসের নাম বলেন, সাল বলতে লজ্জা পান। অথচ নাম, বয়স, (জন্ম-তারিখ), কিংবা বাবা-মায়ের নাম একজনের পরিচয়ের সাভাবিক অনু্ষঙ্গ। যা একজন মানুষের সারাজীবনের (বিশেষ কারনে বদলানোর প্রয়োজন না পড়লে) পরিচয় পত্র বা ভোটার আই.ডি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন এ কিংবা যে কোন ফরম ফিল-আপের ক্ষেত্রে বয়স চাওয়া হয। বয়স না লিখে যদি কেবল জন্ম-তারিখ লেখার প্রচলন হয় তাহলে নামের মত নিজ নিজ জন্ম-তারিখটাকেও সবাই মনে রাখবে, ভালবাসবে। লজ্জা ছাড়াই বলবে/ব্যবহার করবে। আর জন্মের পরই ডাক্তার যে জন্ম-সনদ দিবেন তার তারিখ কখনোই বদলানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি সচেতন হবার পাশাপাশি শিক্ষক সমাজের প্রতি আমার বিশেষ আবেদন থাকবে যে আসুন আসল জন্ম-তারিখ ব্যবহারে বিপ্লব ঘটিয়ে দিন।

 

 

ধন্যবাদান্তে

ড. মুসলিমা জাহান

 

 

 

#চলনবিলের আলো / আপন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com