শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৪:১৩ অপরাহ্ন

ই-পেপার

অভিবাসীদের সুরক্ষায় মধ্যস্বত্বভোগীদের লাগাম টানুন – এম এ মাসুদ

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:১২ পূর্বাহ্ণ

জীবন-জীবিকার তাগিদে কর্মে নিয়োজিত হতে ভিন্ন ভিন্ন পথে এগিয়ে চলে মানুষ। ধনী কিংবা গরিব, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত সবার চাই কর্মসংস্থান। প্রচলিত বেতন বা মজুরিতে চাকুরি বা কাজ করতে চায় অনেক কর্মক্ষম মানুষ। কিন্তু পায় না, কারণ বেকারত্ব। এই বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যতাজনিত কারণে অনেক সময় জীবন ধারণের নূন্যতম ব্যয়ভার মেটানোও সম্ভব হয় না কর্মসংস্থান প্রত্যাশী নারী ও পুরুষদের। নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম হওয়ায় দক্ষ কি অদক্ষ, শিক্ষিত কি অশিক্ষিত অনেক জনশক্তি বেকার, অর্ধবেকার কিংবা প্রচ্ছন্ন বেকারত্বে ভুগছে। ফলে বেকারত্বে ভোগা এসব নারী,পুরুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে বা উন্নত জীবনের আশায় দেশ থেকে পাড়ি জমাচ্ছেন- সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, ইরাক, জর্ডান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, সাইপ্রাসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সফলও হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অনেক মধ্যস্বত্বভোগী সোচ্চার। তারা সোনার হরিণ ধরার স্বপ্ন দেখানোসহ নানান প্রলোভনের ফাঁদে ফেলছেন অভিবাসন প্রত্যাশী নারী,পুরুষদের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সহজ-সরল এসব মানুষের জমিজমা বা ভিটেমাটি বিক্রি করা মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে মানুষরূপী অমানুষগুলো তাদের পাচার করছেন বিভিন্ন দেশে।

বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বলছে, এসব মানব পাচারকারী বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে আফ্রিকার সুদান, লিবিয়া বা অন্য কোনো দেশে পৌঁছে দেওয়ার পর সেখানে দীর্ঘদিন রাখে। শুধু তাই নয়, তাদের অনেককেই নির্যাতন করে দেশে পরিবারের সদস্যদের নিকট থেকে আবার টাকা আদায় করার মতো খবরও আসছে পত্রিকার পাতায়। গত ১৭ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, উন্নত জীবন শুরু করার লক্ষ্যে রাজু নামে এক যুবক প্রায় ১২ লাখ টাকায় চলতি বছরের মার্চে ইতালির উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। একটি মানবপাচারকারী চক্র তাকে প্রথমে দুবাই ও পরে সেখান থেকে লিবিয়া পাঠায়। বেনগাজি পৌঁছানোর পর থেমে যায় ওই অভিবাসন প্রত্যাশীর যাত্রা। চক্রটি তাকে গত ৮ মাস ধরে ‘গেম ঘর’ নামে একটি গোপন আস্তানায় আটকে রাখে, যেখানে অভিবাসীদের নির্যাতন করা হয়। অনেকের ভাগ্যেই জোটে এমন নির্যাতন ঘটনা। এরপর ভূমধ্যসাগর দিয়ে অভিবাসীদের সীমান্ত পার করে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টায় প্রায়শই ব্যবহার করা হয় রাবারের ডিঙির মত হাতে তৈরি নৌকা এবং ওই ডিঙিগুলোতে তোলা হয় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ। ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছার এমন ভয়ঙ্কর যাত্রায় মাঝে মধ্যেই ঘটে নৌকাডুবি আর প্রাণও হারাচ্ছেন অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষ। মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে খুবই বেশি। আবার ঠান্ডায় জমেও মৃত্যু ঘটে অনেকেরই। গত ২৫শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) -এর দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সাল থেকে অবৈধভাবে ইউরোপ যাত্রায় কমপক্ষে ৫ হাজার ৬৮৪ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যুর হয়েছে, যারমধ্যে ১৫৫ জন বাংলাদেশি। আর অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষের মৃত্যুর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১ তম। ২০১৪ থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ কাল পর্যন্ত মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ২৯ হাজার মানুষ। যারমধ্যে পরিচয় মেলেনি ২৩ হাজার ৭১৬ জনের। ২০২১ সাল থেকে গত ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুটে কমপক্ষে দুই হাজার ৮৩৬টি মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়ার তথ্য নথিভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। যা ২০১৯-২০ সালের চেয়ে বেশি।

মূলতঃ ২০১১ সালে লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে বিশৃক্সখলা শুরু হয়। আর এ সুযোগে মধ্য¯^ত্বভোগী (দালাল) চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের লিবিয়া পৌঁছে দেয়। সমুদ্রপথে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা অভিবাসীদের জন্য লিবিয়া একটি প্রধান ট্রানজিট রুট হয়ে উঠেছে। এছাড়া লিবিয়ায় অভিবাসীরা হত্যা, নির্যাতন, যৌন নির্যাতন এবং মানব পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে বছরের পর বছর ধরে সতর্ক করে আসছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ও শিশু পাচারের পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও অনেক নারী ও শিশু পাচার হয়। এদের বলপূর্বক নানা অবমাননাকর ও অমানবিক কাজ, যেমন- দেহ ব্যবসায়, উটের জকি ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়।
ভাগ্যাহত নর-নারীদের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা তাদের এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি, গাড়ি ও বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছে তারা। অন্যদিকে,স্বপ্ন দেখা হতভাগ্য অভিবাসীরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সাগরে মারা যায় অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের অনেকেই। তবুও এতটুকু মায়া হয় না মধ্যস্বত্বভোগীদের।

অথচ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে সমতা আনয়নসহ দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে অভিবাসনের গুরুত্ব অনেক বেশি। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এক অনুষ্ঠানের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশি¶ণ ব্যুরোর দেওয়া তথ্য বলছে, গত ১৩ বছরে ৭৮ লাখ লোক বিদেশে গেছেন। ২১২ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ মার্কিন ডলার। আগস্টে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার, অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার এবং নভেম্বরে এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার। প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত এ অর্থ দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

কিন্তু অভিবাসন খাতের অন্যতম সমস্যা হলো মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম অবসান ঘটাতে হবে। এজন্য আইন সংশোধন করে তাঁদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। করতে হবে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে নিবন্ধনের ব্যবস্থা। অভিবাসন প্রত্যাশীদের গড়ে তুলতে হবে দক্ষ হিসেবে। পাশাপাশি খেয়ে না খেয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো যোদ্ধারা যাতে প্রবাসে কোনো বিপদে না পড়েন এবং দেশে ফেরত আসা প্রবাসীরা দেশে ফিরে তাদের পাঠানো অর্থ ও সহায়সম্পদ নিয়ে কোনো বিড়ম্বনার সম্মুখীন না হন সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২- এ সংঘবদ্ধ মানব পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবপাচার রোধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচার, প্রচারণা চালাতে হবে ব্যাপকভাবে। সর্বোপরি মধ্যস্বত্বভোগীদের খপ্পর থেকে বাঁচাতে সচেতন হতে হবে অভিবাসন প্রত্যাশীসহ সবাইকে। তবেই নিরাপদ হবে অভিবাসন। বাড়বে রেমিট্যান্স। স্বার্থক হবে, ‘থাকব ভালো, রাখব ভালো দেশ; বৈধপথে প্রবাসী আয়-গড়ব বাংলাদেশ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর