প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রথম ধাপের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মৌলিক দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়, বরং শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করা। একটি শিক্ষকের কার্যকর ভূমিকা শিশুরা স্কুলে এবং পরবর্তী জীবনে সফল হতে সহায়তা করে। শিক্ষকদের দায়িত্বগুলো নিম্নরূপ:
১)পাঠ্যবিষয়ক দক্ষতা প্রদান: শিশুদের কাছে পাঠ্যবিষয়গুলোকে সহজ ও বোধগম্য করে তুলে ধরা শিক্ষকের প্রথম দায়িত্ব। শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থাকতে হবে এবং তিনি যে স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, সেই অনুযায়ী জ্ঞান বিতরণ করতে হবে।
২(ব্যক্তিগত যত্ন ও সহানুভূতি: প্রতিটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা বুঝে পাঠদান করা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ থেকে আসে, তাই শিক্ষককে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং বিশেষ যত্ন প্রদান করতে হবে।
৩)মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি: শিক্ষককে শিশুদের মানসিক স্তর বুঝে পড়াতে হবে। শিশুদের শেখার আগ্রহ বাড়াতে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরিতে মনোবিজ্ঞানভিত্তিক পাঠদান পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
৪)শৃঙ্খলা রক্ষা: শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখা শিক্ষকের অন্যতম গুরুত্বর্পূণ দায়িত্ব। এটি অবশ্য কঠোর শাসন দিয়ে নয়, বরং ভালোবাসা ও নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে করা উচিত।
৫)পিতা-মাতার সঙ্গে যোগাযোগ: শিক্ষার্থীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষকের নিয়মিতভাবে পিতা-মাতার সাথে যোগাযোগ করা এবং তাদের পরামর্শ প্রদান করা উচিত, যাতে তারা শিশুদের সঠিকভাবে গাইড করতে পারেন।
৬)শিশুর পাঠদান পদ্ধতি ও কৌশল: মনোবিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি
শিশুরা মূলত চারটি ধাপের মাধ্যমে শেখে: পর্যবেক্ষণ, অনুকরণ, অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধান। এই ধাপগুলোকে মাথায় রেখে শিক্ষকদের পাঠদান কৌশল তৈরির প্রয়োজন। মনোবিজ্ঞানভিত্তিক পাঠদান পদ্ধতির মধ্যে কয়েকটি কৌশল নিম্নরূপ:
১)খেলার মাধ্যমে শেখানো: শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই খেলতে পছন্দ করে, এবং খেলার মধ্যে দিয়ে তাদের শেখানোর পদ্ধতিটি অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার মাধ্যমে বর্ণমালা, সংখ্যা এবং সাধারণ জ্ঞান শেখানো যেতে পারে।
২)মৌখিক নির্দেশনা ও প্রশ্নের মাধ্যমে শেখানো: শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করা এবং তাদের চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া শিশুদের সৃজনশীলতা ও কৌতূহল বৃদ্ধি করে। শিশুরা যদি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারে, তাহলে তারা সেটি শেখার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়।
৩)সক্রিয় অংশগ্রহণ: পাঠদানে শিশুদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। তারা কেবল শ্রোতা না থেকে নিজে কাজ করে শিখুক, এইভাবে শিশুদের শেখার আগ্রহ ও ধারণার গভীরতা বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, গণিতের কোন ধারণা শেখানোর সময় তাদের হাতে গণনা বা সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
৪)সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শিক্ষা: পাঠ্যসূচির পাশাপাশি শিশুদের সামাজিক আচরণ, ভদ্রতা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শেখাতে হবে। এই পদ্ধতিটি শিশুদের ভবিষ্যতে ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক।
৫)ভিজুয়াল ও শ্রবণশক্তিনির্ভর পদ্ধতি: শিশুরা ছবি, রঙ এবং শব্দের মাধ্যমে খুব ভালোভাবে শিখতে পারে। তাই ভিজুয়াল এইড এবং অডিও-ভিজুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠদান করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠে শিশুদের চিত্র ও ভিডিও দেখিয়ে তাদের ধারণা আরও পরিষ্কার করা সম্ভব।
৬)প্রশংসা ও উৎসাহ: শিশুরা প্রশংসা ও উৎসাহের মাধ্যমে খুব ভালোভাবে অনুপ্রাণিত হয়। শিক্ষকের উচিত শিশুদের ছোটখাটো কাজকেও স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের প্রাপ্য প্রশংসা করা।
শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে কেবল পাঠদান নয়, বরং শিশুদের সম্পূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করা অন্যতম প্রধান দিক। মনোবিজ্ঞানভিত্তিক এই পদ্ধতি ও কৌশলগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করে শিক্ষকরা শিশুদের শেখার প্রক্রিয়াকে আনন্দময় ও ফলপ্রসূ করতে পারেন।
লেখক –
মোঃ মহিদুল ইসলাম সহকারী শিক্ষক
বাংলাহিলি ১ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
হাকিমপুর, দিনাজপুর।