বাংলাদেশ-ভারত’ বন্ধু দেশ’, ‘প্রতিবেশী দেশ’
তবে বন্ধুত্বটা সব সময় মুখে মুখেই এবং নিজের স্বার্থেই ব্যবহার করে আসছে ভারত সুদূর ১৯৭১ সাল থেকে ।বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পদার্পণ করলেও তার সীমানা নয় স্বাধীন।ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ (বিএসএফ) এর হাতে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে কত-শত বাঙালি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচ্য কয়েকটি ঘটনা হলো:
*১লা সেপ্টেম্বর রোববার। সময় রাত ৯-টা। ভারতের ত্রিপুরায় থাকা ভাইকে দেখতে মা সঞ্জিতা রাণী দাসের সঙ্গে রওয়ানা হয় ১৪ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাস। মৌলভীবাজার যেলার কুলাউড়া উপযেলার লালারচক সীমান্ত দিয়ে স্থানীয় দুই দালালের সহযোগিতায় সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। কাঁটাতারের বেড়ার নিকটবর্তী হ’তেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ (বিএসএফ) গুলি চালায় তাদের উপর। এতে কিশোরী স্বর্ণা দাস (১৪) মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়। নিহত স্বর্ণা মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপযেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের বাসিন্দা পরেন্দ্র দাসের মেয়ে। সে স্থানীয় নিরোদ বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
এর মাত্র সাত দিনের মাথায় ৮ই সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত যেলা ঠাকুরগাঁওয়ে। জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপযেলার ধনতলা সীমান্তএলাকার ৩৯৩ নম্বর মেইন পিলার এলাকা দিয়ে স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় কয়েকজন সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকালে বিএসএফের ডিঙ্গাপাড়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে কিশোর জয়ন্ত (১৫) ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বিএসএফ সদস্যরা তার লাশ নিয়ে যান। গুলিতে জয়ন্তের বাবা মহাদেব কুমার সিংহ ও স্থানীয় অপর ব্যক্তি দরবার আলীও আহত হন। তাছাড়া আগষ্ট’২৪ মাসে নিহত হয় ৩ জন ও আহত হয় ৩ জন।
(সেপ্টেম্বর’২৪) মাসের শুরুর দিকে মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে বিএসএফ কর্তৃক দুই বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীর এই নির্মম হত্যাকান্ড এক যুগ পূর্বে সংঘটিত আরেক নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার কিশোরী ফেলানীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারী ভোরে কুয়াশাঢাকা আলো-আধারিতে মই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। ফেলানী কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে তার পিতার সঙ্গে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল। পিতা নূরুল ইসলাম কুড়িগ্রাম যেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের বাসিন্দা। থাকতেন আসামের বঙ্গাইগাঁও এলাকায়। সেখানে কাজ করতেন একটি ইট ভাটায়। ফেলানীও কাজ করত গৃহকর্মীর। বাংলাদেশে নিজ খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় ফেলানীর। সে উপলক্ষেই দেশে ফেরা। মইয়ের সামনে ছিল বাবা, পিছনে মেয়ে। এ সময় বিএসএফ টের পেয়ে গুলি ছুড়ে। এতে ফেলানীর বাবা বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ হয়ে কাঁটাতারে আটকে যায় কিশোরী ফেলানী। সে ছটফট করে পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু কেউ পানি নিয়ে এগিয়ে যায়নি।অবশেষে কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ফেলানী। প্রায় ৫ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে তার লাশ। ভেঙ্গে যায় ফেলানীর স্বপ্ন। এ ঘটনায় তোলপাড় হয় সারা বিশ্বে। নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বত্র। আদালতে মামলাও হয়। কিন্তু এখনো বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার।
শুধু কিশোরী ফেলানী, স্বর্ণা বা কিশোর জয়ন্ত নয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের মানুষকে সীমান্তে গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করছে প্রতিনিয়ত। পরস্পর বন্ধুত্বের (?) দাবীদার দুই দেশের সীমান্তে একটি দেশ কর্তৃক নিয়মিতভাবে অন্য দেশের নাগরিককে পাখির মত গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতে বুঝা যায়, মুখে বন্ধুত্বের বুলি আওড়ালেও অন্তরে কেবলই স্বার্থপরতা ও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা। নিম্নোক্ত পরিসংখ্যানই যার জাজ্বল্য উদাহরণ।-বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। অপর মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর মতে এ সংখ্যা ৫৮২ এবং এ সময়ে আহত হয়েছেন ৭৬১ জন। ‘অধিকার’-এর দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০০০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০৬৪ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩১২ বার হামলা চালানো হয়েছে। এতে ১২৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি হামলায় ১১জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি হামলায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন ও ২০০০ সালে ৪২টি হামলায় ৩৯ জন নিহত হন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী একুশ শতকের প্রথম দশকে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে সহস্রাধিক বাংলাদেশী। ‘আসক’-এর তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে নিহত হন ৩১ জন। ২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২৩ জন। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সীমান্ত হত্যা। যা চরম উদ্বেগের কারণ।
তাই সরকারের কাছে এই দাবি জানাই যে অতি দ্রুত সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।