১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম—১৭ (কক্সবাজার—মহেশখালী) আজ থেকে ৫২ বছর আগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জিতেছিলেন তখনকার তরুণ নেতা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। গতকাল ১৭ ই অক্টোবর সোমবার অনুষ্ঠিত কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৭৭ বছর বয়সী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, সেদিনের পরাজিত, বঙ্গবন্ধুর পছন্দের প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেল হকের কৃতি সন্তান ৪২ বছর বয়সী, আনারস মার্কা প্রার্থী শাহীনুল হক মার্শাল। কক্সবাজারের আনাছে কানাচে একটাই শব্দ এই এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছেলেই নিলেন পিতার মধুর প্রতিশোধ!
তথ্য মতে, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম—১৭ (কক্সবাজার—মহেশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তৎকালীন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের নেতা এ কে এম মোজাম্মেল হক। একই সাথে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন সে সময়ের তরুণ ও মেধাবী আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, কিন্তু মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন না পেয়ে মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। কেউ বুঝতেই পারেননি ২৫ বছরের একজন তরুণ (মোস্তাক) এর কাছে বিপুল ভোটে হেরে যাবে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী। হ্যাঁ, সবাইকে তাক লাগিয়ে বাস্তবেও ঘটেছিল তাই। নৌকার প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সবাইকে অবাক করে দেন সেদিনের তরুণ মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। বলাবাহুল্য, ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের গণজোয়ারের মাঝেও পূর্ব পাকিস্তানে যে তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছিল তার একটি কক্সবাজারের এই আসনটি। বঙ্গবন্ধু এতে ক্ষুব্ধ হননি, বরং মোস্তাকের জনপ্রিয়তা দেখে বিস্মিত হয়ে এক পর্যায়ে তাকে কাছে টেনে নেন। বরং ‘৭৩ এর নির্বাচনে তৎকালীন চট্টগ্রাম—১৭ (সদর—রামু) আসনে সেই মোস্তাকের ওপরই আস্থা রাখেন বঙ্গবন্ধু। এ কে এম মোজাম্মেল হকের পরিবর্তে নৌকা তুলে দেন মোস্তাকের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন মোস্তাক। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও আস্থা রাখেন মোস্তাকের ওপর। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনেও এমপি হন মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ইমেজ আর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে চেয়ারম্যান হন এবং টানা প্রায় ১১ বছর কক্সবাজার জেলা পরিষদের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা কক্সবাজার সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও খেলাপির কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কানিজ ফাতেমাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে, কক্সবাজার জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী গতকাল অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফের মনোনয়ন পান। কিন্তু সেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি প্রয়াত মোজাম্মেল হকের ছেলে মার্শাল। জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মার্শালের জয় সেদিনের পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে গণমানুষের মুখে মুখ ঝড় উঠেছে। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। নির্বাচনে তার এই জয়কে বিপুল অর্থে কেনা বলে স্থানীয়রা অভিহিত করলেও এ পরাজয়ের জন্য মোস্তাক দম্পতিকেও দুষছেন অনেকে।
মোস্তাক আহমদ চৌধুরীকে দলীয় ভাবে মনোনয়ন দেয়ায় জেলার চারজন এমপি, কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মাঠ চষে বেড়ানোর পরও শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে না পারায় সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা বলছেন, টাকা ও একটি পরিবারকে খুশি করতে গিয়ে শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর বিপক্ষে ভোট করেছেন জেলা ও উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আবার অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়ার নামে হুমকি দিয়েছেন, এটা পরাজয়ের কয়েকটি কারণের একটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালের বিবর্তনে সেই জনপ্রিয়তা ও ইমেজ হারিয়েছেন মোস্তাক আহমদ। প্রায় ১১ বছর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেছেন। একটা সময়ে আত্মম্ভরিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। এমপি হওয়ার পর তার স্ত্রীকেও খুব বেশি কাছে পায়নি কক্সবাজারের মানুষ। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পেয়ে এই রাজনীতিক দম্পতি বেশিরভাগ সময় পার করেন চট্টগ্রাম ও ঢাকার বাসায়। ফলে ক্রমান্বয়ে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন কক্সবাজারবাসীদের কাছ থেকে। আর সেই জনবিচ্ছিন্নতার ফল আজকের ভরাডুবি।
কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন নিশ্চিত করেন কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনের রির্টানিং কর্মকর্তা ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহীনুল হক মার্শাল (আনারস)। তিনি ৫৭৮ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন,
তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী (মোটর সাইকেল) পেয়েছেন ৩৯৫ ভোট। অপর দুই প্রার্থী মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছার (তালগাছ) পেয়েছেন ১ ভোট এবং কথিত মঙ্গল পার্টির নেতা জগদীশ বড়ুয়া (প্রজাপতি) পেয়েছেন ৯ ভোট।
সোমবার (১৭ অক্টোবর) সকাল ৯ টা থেকে ৯ টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোট শুরু হয়। দুপুর ২টা পর্যন্ত ৯৯৪ জন ভোটারের মধ্যে ৯৮৮ জন তাদের ভোট প্রয়োগ করেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদের ৫টি ভোট বাতিল করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ।
নির্বাচনের রির্টানিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য মতে, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন ১ নম্বর ওয়ার্ডে (টেকনাফ, উখিয়া ও রামু উপজেলা) আশরাফ জাহান কাজল (দোয়াত কলম), ২ নম্বর ওয়ার্ডে (কক্সবাজার, ঈদগাঁও ও মহেশখালী উপজেলা) হুমায়রা বেগম (হরিণ), ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ( চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলা) তানিয়া আফরিন (দোয়াত কলম) বেসরকাররি ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন।
সাধারণ সদস্য বিজয় লাভ করেন পদে ১ নম্বর ওয়ার্ডে (টেকনাফ উপজেলা) জাফর আহমদ (তালা), ২ নম্বর ওয়ার্ডে (উখিয় উপজেলা) হুমায়ন কবির চৌধুরী (তালা), ৩ নম্বর ওয়ার্ডে (কক্সবাজার সদর উপজেলা) মাহমুদুল করিম মাদু (হাতি), ৪ নম্বর ওয়ার্ডে (রামু উপজেলা) ফরিদুল আলম (হাতি), ৬ নম্বর ওয়ার্ডে (চকরিয়া উপজেলা) মোঃ আবু তৈয়ুব (টিউবওয়েল), ৭ নম্বর ওয়ার্ডে (পেকুয়া উপজেলা) মোহাম্মদ শওকত হোসেন (তালা), ৮ নম্বর ওয়ার্ডে (মহেশখারী উপজেলা) শহীদুল ইসলাম মুন্না (হাতি), ৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কুতুবদিয়া উপজেলা) নুরুল ইসলাম (টিউবওয়েল) বেসরকাররি ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন। এর আগে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে (ঈদগাঁও উপজেলা) বিনাপ্রতিদ্বন্ধীতায় নির্বাচিত হয়েছেন আরিফুল ইসলাম।