শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০১:০৭ অপরাহ্ন

ই-পেপার

দারিদ্র্যকে জয় করতে প্রয়োজন আত্নকর্মসংস্থান – এম এ মাসুদ

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২২, ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমুহের নানাবিধ সামাজিক সমস্যার মধ্যে দারিদ্র্য হচ্ছে অন্যতম সমস্যা। মানবজাতির হাজারো সমস্যার মূলে রয়েছে এই দারিদ্র্য। এ জন্য দারিদ্র্য একটি অভিশাপ। দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খানের মতে, ‘যে আর্থিক অবস্থা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অন্তরায় সেটাই দারিদ্র্য।’
ডঃ হিরোসি নাকাজিমার মতে, ‘দারিদ্র্য হলো বিশ্বের মারাত্নক ব্যাধি।’ তবে উন্নত বিশ্বে দারিদ্র্য যে অর্থে ব্যবহৃত হয় অনুন্নত দেশে ঠিক সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সামাজিক প্রেক্ষাপট ও স্থান-কাল ভেদে দারিদ্র্যের প্রকৃতি আলাদা হয়। দরিদ্র মানুষ তার মৌলিক চাহিদা যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, অভাব আর হতাশা হয় নিত্যসঙ্গী। দারিদ্র্য ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক কর্মদক্ষতা অর্জন ও বজায় রাখা, সামাজিক ভূমিকা পালন, সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। দারিদ্র্যতা মানুষকে ঠেলে দেয় বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন- কিশোর অপরাধ,চুরি, ডাকাতি,ছিনতাই, খুন, রাহাজানি, মাদক ইত্যাদির দিকে। সহজ কথায় বলা যেতে পারে, দারিদ্র্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এমন হাজারো সমস্যা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রাগনার নার্কস দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ধারণায় বলেছেন,‘একটি দেশ দরিদ্র, কারণ সে দরিদ্র।’ অনুন্নত দেশসমুহের লোকের আয় কম বলে লোকের সঞ্চয়ের পরিমাণ কম হয়। সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম হয়। বিনিয়োগ স্বল্পতার কারণে মূলধনের অভাব দেখা দেয়। মূলধনের অভাবে উৎপাদনের পরিমাণও কম হয়। এর ফলে অনুন্নত দেশের মাথাপিছু আয় কম হয়। এভাবে অনুন্নত দেশসমুহ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
আমাদের দেশে যে হারে বাড়ছে জনসংখ্যা সে হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রাম-শহর সবখানেই বেকারত্বের হাতছানি। গেল বছর দেশের বে-সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তিতে ৫৪ হাজার পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৮৭ লাখ যাদের সবাই নিবন্ধিত। এ থেকে অনুমান করতে কষ্ট হয় না দেশে বেকারত্বের তীব্রতা সম্পর্কে। দীর্ঘকালীন বেকারত্ব ও ছায়া বেকারত্ব আমাদের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে পঙ্গু করে দিচ্ছে। দেখা দিচ্ছে দারিদ্র্য। এ অবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় আত্নকর্মসংস্থানের সুযোগ বা পরিবেশ করে দিতে হবে যাতে করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফল হয়।
দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের উচিত হবে কোনো কাজকেই ছোট করে না দেখা, লেখা-পড়া শিখে কেবল চাকুরীর সন্ধান নয়, বরং স্ব-উদ্যোগে কিছু করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে সাময়িক বিপর্যয় আসতে পারে, সেই বিপর্যয়ে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। বিপর্যয় কেটে ওঠার জন্য ধৈর্য, সাহস ও আত্নপ্রত্যয়ী হতে হবে। আত্নকর্মসংস্থানের উদ্যোগে পরিবারের সকল সদস্যের সহানুভূতি ও সহযোগিতা নিতে হবে। সামাজিক প্রতিকূলতা সম্মুখীন হলে তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে হবে ও নিজের গুণাবলী দিয়ে সবার প্রশংসা অর্জন করতে হবে। নিজের শ্রমে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে সর্বাত্নক। আমাদের মনে রাখতে হবে সততা ও নিষ্ঠাই হলো আত্নকর্মসংস্থানের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ড, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বহুবিধ সামাজিক উদ্যোগের সমন্বিত প্রয়াসে গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী ২০০৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে তা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের এ গতি অব্যাহত রেখে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ এখন অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে এগিয়ে। তারপরেও মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। জনসংখ্যার এই উল্লেখযোগ্য অংশকে বাদ দিয়ে বা দরিদ্র রেখে কাঙ্খিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বেশ দূরুহ।
দেশে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রতার হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সরকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ  প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক সুরক্ষা নেটের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছে। এক্ষেত্রে সরকার দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
সে যাই হোক, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রতার হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চাইলে এবং দারিদ্র্য নামক অভিশাপ থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতাও অপরিহার্য। ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাতে হবে। আত্নকর্মসংস্থানের পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।  তাহলেই স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ, কমবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে সেটাই প্রত্যাশা।
এম এ মাসুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর