সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫০ পূর্বাহ্ন

ই-পেপার

২২৭ কর্মদিবস পরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় চার্জসীট দিতে পারেনি পুলিশ

নির্মল বড়ুয়া মিলন, রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি:
আপডেট সময়: সোমবার, ১০ মে, ২০২১, ৯:৩৯ অপরাহ্ণ

গ্রীণ হিল এনজিও পরিচালিত সূর্যের হাসি ক্লিনিক ছ্টো হরিণা শাখার একজন নারীকে নানাভাবে অনলাইনে সাইবার অপরাধ সংগঠিত করার অপরাধে রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করার প্রায় এক বছর (২২৭ কর্মদিবস) অতিবাহিত হওয়ার পরও পাঁচজন অভিযুক্তদের মধ্যে একজন আসামী (নকুল চন্দ্র শর্মা) ব্যতিত বাকি চারজন অভিযুক্ত আসামীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি রাঙামাটি জেলার বরকল থানা পুলিশ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এ মামলা তদন্ত করে চুড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশীট) আদালতে জমা দেয়ার আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও কিন্তু এধরনের একটি চাঞ্চল্যকর মামলার চার্জশীট (চুড়ান্ত প্রতিবেদন) ২২৭ কর্মদিবদেও আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ।

বরকল থানা মামলা নং-০১ তারিখ ২২ জুন-২০২০ এবং রাঙামাটি কগনিজেন্স আদালতের মামলা নং- ২০৯/২০২০।
অভিযোগ সুত্রে জানাযায়, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ইলেক্টনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে প্রতারনার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এছাড়া খাবারে নেশা জাতীয় দ্রব মিশিয়ে তা পান করিয়ে আপত্তিকর ভিডিও ধারন এবং ঐ ভিডিও সহ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করে সাইবার অপরাধ সংগঠিত করায় রাঙামাটি জেলার বরকল থানায় গত ২২ জুন-২০২০ ইংরেজি তারিখ ভুক্তভোগি রাখী খীসা বাদি হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আজ ১০ মে-২০২১ ইংরেজি তারিখ এ মামলার ২২৭ দিন পূর্ণ হলো।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা অভিযুক্তরা আসামীরা হলো, ১। নকুল চন্দ্র শর্মা, পিতা-মৃত সুধন চন্দ্র শর্মা, গ্রাম- হরিণা বাজার এলাকা, ২। মো. সোহেল ৩। মো. সুমন পারভেজ উভয়ের পিতা- আব্দুল মালেক, গ্রাম- হরিণা বাজার এলাকা (আমতলা), ৪। মো. ইউছুফ রানা, পিতা-মৃত আলি আহম্মদ, গ্রাম- হরিণা বাজার এলাকা (আমতলা), থানা- বরকল, উপজেলা- বরকল ও ৫। অমর শান্তি চাকমা, পিতা- চিরনজীব চাকমা, মাতা- ইন্দ্রদেবী চাকমা, গ্রাম-কুসুমছড়ি, সুভলং, বর্তমান ঠিকানা- গ্রাম-ধনুবাগ-মাষ্টার পাড়া (সূর্যের হাসি ক্লিনিক ছ্টো হরিণা শাখা), থানা- বরকল, উপজেলা- বরকল, জেলা-রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।

গত ২৭ ডিসেম্বর-২০২০ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মজ্জারটেক এলাকার সনজিত সেলুন থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন(পিবিআই) সদস্যারা আসামী নকুল চন্দ্র শর্মা (৩১) কে আটক করে চট্টগ্রামের দক্ষিণ কুলশী পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আসামীর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর পিবিআই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরকল থানার সাব ইন্সপেক্টর মো. কামাল হোসেনের কাছে হস্তান্তর করেন।
পরের দিন ২৮ ডিসেম্বর-২০২০ রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় এনে মামলার নথি প্রস্তুত করে রাঙামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আসাদ উদ্দীন আসিফ এর আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরন করেন।

গত ৬ জানুয়ারি-২০২১ বুধবার দুপুর ২টায় রাঙামাটি জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট বেলাল হোসেন ভার্চুয়াল আদালত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার রিমান্ড আবেদন শুনানীর মাধ্যমে অভিযুক্ত আসামী নকুল চন্দ্র শর্মাকে রাঙামাটি কোতয়ালী থানায় পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলার আলামত উদ্ধারের জন্য ২ দিনের রিমান্ড মন্জুর করেন।এ মামলার মুল হোতা নকুল চন্দ্র শর্মা বর্তমানে রাঙামাটি জেলা কারাগারে আটক রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ মামলার ২ নাম্বার অভিযুক্ত আসামী মো. সোহেল পারভেজ চট্টগ্রামের ইপিজেট এলাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে চাকুরী করছে।

৩ নাম্বার অভিযুক্ত আসামী মো. সুমন পারভেজ বরকল উপজেলার ছোট হরিণা বাজারে নিয়মিত মোবাইল দোকানে বসে ব্যবসা করছে, মো. সুমন স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতির জড়িত এবং সে ছোট হরিণা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির একজন নেতা।

৪ নাম্বার অভিযুক্ত আসামী মো. ইউছুফ রানা প্রায় প্রতিদিন ছোট হরিণা টু রাঙামাটি স্পিডবোট নিয়ে ড্রাইভার হিসাবে যাতায়ত করে এছাড়া মো. ইউছুফ রানার হরিণায় একটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে।

মামলার অপর ৫ নাম্বার অভিযুক্ত আসামী অমর শান্তি চাকমা বর্তমান সূর্যের হাসি ক্লিনিক ছ্টো হরিণা শাখায় ভারপ্রাপ্ত ক্লিনিক ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে। একজন ছাড়া অভিযুক্তরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় রয়েছে।
অথচ পুলিশের খাতায় অভিযুক্ত আসামীরা সকলেই পলাতক।

এমামলার বাদি বলেন, অভিযুক্ত আসামীদের সাথে পুলিশের শখ্যতা ও গোপন আতাত রয়েছে। এছাড়া ছোট হরিণায় কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সাথে ছবি প্রমান করে, তাদের ছত্রছায়ায় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে আসামীরা দাপটের সহিত এলাকায় চলাফেলা করছে। বাদি রাখি খীসা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারছি, দেশে যে কোন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে আইন শৃক্সখলা বাহিনী এক থেকে তিনদিনের মধ্যে অভিযুক্ত আসমীকে গ্রেপ্তার করছেন। অথচ আজ ১০ মে-২০২১ এমামলাটি আগামী মাসের ২৬ তারিখ আসলে মামলা দায়েরে এক বছর পুর্ণ হবে। বরকল থানা পুলিশ ৫জনের মধ্যে ১জন আসামী ব্যতিত বাকিদের গ্রেপ্তার করতে পরেনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় অভিযুক্ত মো. সোহেল, মো. সুমন পারভেজ, অমর শান্তি চাকমা ও মো. ইউছুফ রানা বীরদর্পে কোন ধরনের বাঁধা-বিপত্তি ছাড়া ছোট হরিণা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৈ পুলিশ তো এদের গ্রেপ্তার করছে না।

এদিকে উল্টা অভিযুক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার না করায় সূর্যের হাসি ক্লিনিক এর চাকুরী থেকে ¯ে^চ্ছায় অব্যহতি (রিজাইন) দেয়ার হুমকি প্রতিনিয়ত দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী রাখি খীসা। বাদি জানান, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রটির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করায় এবং অভিযুক্ত আসামী বর্তমান সূর্যের হাসি ক্লিনিক ছ্টো হরিণা শাখার ভারপ্রাপ্ত ক্লিনিক ম্যানেজার অমর শান্তি চাকমার নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে জন্য আমাকে (বাদিকে) বিভিন্ন ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাদের কথা না মানায় দুর্গম এলাকায় আমাকে বদলী করা হয়েছে।

এবিষয়ে সূর্যের হাসি ক্লিনিক ছ্টো হরিণা শাখার ভারপ্রাপ্ত শাখা ম্যানেজার মামলার অপর অভিযুক্ত আসামী অমর শান্তি চাকমা মুঠোফোনে জানায়, আপত্তিকর ভিডিওটি মুলতঃ মাঠকর্মী মৌসুমী চাকমার মোবাইল থেকে সূর্যের হাসি ক্লিনিক এর প্রধান কার্যালয় গ্রীণ হিলে পাঠানো হয় এছাড়া মামলার তদন্তকারী অফিসার (আইও) তার মোবাইল ফোনটি জব্দ করে আইও জিম্মায় নিয়ে গেছেন এবং আপত্তিকর ভিডিওটি আমার মোবাইলেও ছিলো যা পুলিশ খুজে পেয়েছেন, বলে স্বীকার করে অমর শান্তি চাকমা।

বরকল থানায় গত ২২ জুন-২০২০ তারিখ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪ (২)/ ২৫ (২)/ ২৯/ ৩০/ ৩১ (২)/ ৩৫ (২) ২০১৮ ধারায় দায়ের করা উল্লেখিত ৫ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলার প্রায় এক বছর যাবৎ তদন্ত কার্যক্রম চলছে।

এবিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর মো. কামাল হোসেন বলেন, গতকাল ২৭ ডিসেম্বর-২০২০ তারিখ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মজ্জারটেক এলাকার সনজিত সেলুন থেকে পিবিআই এর সদস্যারা আসামী নকুল চন্দ্র শর্মা (৩১) কে আটক করে তার পর চট্টগ্রামের দক্ষিণ কুলশী পিবিআই কার্যালয়ে থেকে আমি সঙ্গিয় ফোর্সসহ নকুল চন্দ্র শর্মাকে রাঙামাটিতে নিয়ে আসি। তার সাথে থাকা মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি-২০২১ তারিখ রাঙামাটি জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট বেলাল হোসেন ভার্চুয়াল আদালতের অনুমতি ক্রমে পুলিশি হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ কালিন আসামীর মোবাইল ফোনে থাকা আলামত উদ্ধার করি ২ দিনের রিমান্ড শেষে নকুল চন্দ্র শর্মাকে আদালতের মাধ্যে পূণরায় জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।

নকুল চন্দ্র শর্মার নিকট থেকে জব্দ করা ডিভাইজ (মোবাইল ফোন)টি ডিজিটাল তথ্য উদঘাটনের লক্ষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) এর ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। গত এপ্রিল-২০২১ মাসের ১৫ তারিখে মামলার নাম্বার উল্লেখ করে মেসেস পাঠিয়েছেন প্রতিবেদন প্রস্তুত। লকডাউনের কারণে আমাদের পুলিশের সদস্যরা ডাক নিয়ে কেউ ঢাকায় যাচ্ছেন না। কেবলমাত্র প্রতিবেদন বা কাগজের রিপোর্ট হলে এতদিন ডাকের মাধ্যমে পেয়ে যেতাম কিন্তু ডিভাইজ (মোবাইল ফোন)টি থাকায় যে কাউকে ঢাকায় গিয়ে ডিভাইজসহ পিবিআই এর ফরেনসিক ল্যাব থেকে ডিভাইসসহ রিপোর্টটি আনতে হবে। লকডাউন তুলে নিলে ঢাকার সাথে গাড়ি যোগাযোগ শুরু হলে আশা করি এ মামলার চার্জসীট (চুড়ান্ত প্রতিবেদন) আদালতে জমা দিতে পারবো।

এ মামলার আইও বরকল থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. কামাল হোসেন আরো বলেন, রাঙামাটি কগনিজেন্স আদালত আমাকে আদালতে তলব করে মামলার চার্জসীট (চুড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিলে বিলম্বের কারণ জানতে চেয়েছেন। আমি আদালতের নিকট থেকে ২ বার সময় নিয়েছি। আশা করছি আগামী জুন মাসে ভিতর মামলার চার্জসীট (চুড়ান্ত প্রতিবেদন) আদালতে দাখিল করিতে সক্ষম হবো।

এ মামলার ৫ জন অভিযুক্ত আসামীর মধ্যে কেবল মাত্র ১ জন আসামী গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকি ৪ জন আসামী কেন বা কি কারণে গ্রেপ্তার হচ্ছে না ? মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর মো. কামাল হোসেনের নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, পিবিআই এর ফরেনসিক ল্যাবে রিপোর্ট পর্যলোচনা করে বাদ বাকি ৪ জন আসামীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় অভিযুক্ত আসামী মো. সোহেল, মো. সুমন পারভেজ, অমর শান্তি চাকমা ও মো. ইউছুফ রানার সাথে ছ্টো হরিণায় কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের বিষয়ে এ মামলার আইও বরকল থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে তিনি বলেন, সরকারী কোন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহিত ছবি তোলে কোন অপরাধীর সেই ছবি পেইজবুকে আপলোড দিলে সেই আসামী বা অপরাধী নয় তা প্রমান হয় না। দেশে তো ভিআইপিদের সহিত অনেক অপরাধীর ছবি দেখা যায়। তার পরও কি অপরাধীরা আইনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে ? পুলিশ তো এদের গ্রেপ্তার করছে এবং আদালতে অপরাধীর সাজা হচ্ছে।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় অভিযুক্ত আসামীর সাথে ছ্টো হরিণায় কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আমলে নেয়া উচিত।

 

#আপন_ইসলাম


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর