পাবনার ঈশ্বরদীতে সেই আলোচিত তপু হত্যার প্রধান আসামি সহ দুজনকে আটক করেছে থানা ও আমবাগান ফাঁড়ী পুলিশ। মাদক সেবনের দ্বন্দ্বে রুমে আটকিয়ে ভয়ভীতি দেখাতে গিয়েই উত্তেজিত হয়ে বন্ধু তপু হোসেনকে (১৪) হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে গ্রেফতারকৃত দুই ঘাতক জয়নাল আবেদিন জয় (২০) ও ঈশা খলিফা (১৯),। (২৪ জুন) সোমবার সন্ধ্যায় আদালতে গ্রেফতারকৃতরা তপু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোঃ মাসুদ আলম। নিখোঁজের সাতদিন পর গত শনিবার (২২ জুন) রাত দুইটার দিকে ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের পেছনে মশুরিয়াপাড়াস্থ অরণ্য ছাত্রাবাসের তিন তলার ৩০৫ নং কক্ষের ট্রাংক থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ১৫ জুন সকাল এগারোটার দিকে কিশোর তপু হোসেন নিখোঁজ হয়। এই ঘটনায় নিহত তপু হোসেনের বাবা মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিক বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। হত্যাকান্ডের রহুস্য উদঘাটনে উঠে আসে ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের পেছনে মশুরিয়াপাড়াস্থ রিক্সাচালক আবুল কাশেম প্রামানিকের ছেলে নিহত তপু হোসেন ও একই এলাকার রাজন খলিফার ছেলে ঈশা খলিফাা দুইজন বন্ধু। তারা এক সঙ্গে চলাফেরা করতো। তাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাজশাহীর বাঘার চক রাজাপুর এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে ঈশ্বরদী সরকারী কলেজ সংলগ্ন অরণ্য ছাত্রাবাসের ম্যানেজার মোঃ সোহেলের সঙ্গে। এই সোহেলের মাধ্যমেই ওই ছাত্রাবাসে থাকা পাবনার আতাইকুলা থানার দুবলিয়াচর এলাকার জিয়াউর রহমানের ছেলে আতাইকুলা থানার হত্যা মামলার প্রধান আসামী মাদকাসক্ত জয়নাল আবেদিন জয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা সবাই সংলগ্ন অপর মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক মোঃ আলি হোসেন হাসুর দোকানে বসে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করতো। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পূর্ব থেকেই নিহত তপুর বাবা আবুল কাশেমের সঙ্গে হাসুর বিরোধ চলে আসছিল। এর সঙ্গে হাসুর দোকানে বসে ছেলের মাদক সেবন করার বিষয়টি নিয়ে হাসুর সঙ্গে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। এক পর্যায় নিখোঁজের ১০/১২ দিন আগে তপুকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করার হুমকি দেয় হাসু ও তার মা রেনু বেগম । ছাত্রাবাস মালিক হাসুর সঙ্গে অরণ্য ছাত্রাবাসের ম্যানেজার সোহেল ও ঈশা খলিফার সুসম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের জের ধরেই তপুকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে হাসু। তখন সোহেল ও ঈশা খলিফা অরন্য ছাত্রাবাসে থাকা খুনি মামলায় জামিনে আসা জয়ের সঙ্গে আলাপ করে। তপুকে শায়েস্তা করলে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে সোহেল জানাই জয়কে। এরমধ্যে মাদকের টাকা ও হত্যা মামলা এবং ছাত্রাবাসের ভাড়ার বকেয়া টাকাসহ বেশ কিছু টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে জয়। জয় তখন রাজি হয়ে যায় কাজটি করার জন্য। তারপর’ই শায়েস্তা করতে ভারতীয় ক্রাইম পেট্রোল সিরিজের ক্রাইমসিন দেখে ঘটনার এক সপ্তাহ আগে ওই ছাত্রাবাসে থাকা আরেক ছাত্রের মোবাইল ফোন চুরি করেন জয়। ওই ফোন দিয়েই ঘটনার দিন (১৫ জুন) বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে তপুকে অরণ্য ছাত্রাবাসের নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যায় জয়। তপু হোসেন তখন জয়ের কক্ষে গিয়ে দু’জনে মিলে গাঁজা সেবন করে। এরই মধ্যে সোহেল ও ঈশা খলিফা ওই কক্ষে প্রবেশ করে রুমের দরজা আটকিয়ে দেয়। এরপর তারা তপুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয় যাতে করে তপু কারোও সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। তখন তপু হোসেন চিৎকার করার চেষ্টা করলে সোহেল পেছন থেকে তপুর মুখ চেপে ধরে। আর ঈশা খলিফা ওই কক্ষে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে বুকে আঘাত করে হত্যা করে। এরপর জয়ের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে তপুর হোসেনের হাত বেঁধে বস্তার মধ্যে ভরে রাখে। এরপর তারা চাদর দিয়ে রক্ত পরিস্কার করে। হত্যার আলামত নষ্ট করতে তারা চাদরটিকে পরিস্কার করে শুকিয়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে। একই সঙ্গে হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো ছুরিটি সাবান ও ডিটারজেন দিয়ে ধুয়ে বালু দিয়ে পরিস্কার করে। হাতে গ্লোভস পরে ছুরির হাতল সিরিচ কাগজ দিয়ে ঘষে। এরপর ছুরিটি পলিথিনে ভরে লুকিয়ে রাখে। এরপর সোহেলকে ওই কক্ষে রেখে তপুর মোবাইল ফোন নিয়ে জয় এবং ঈশা খলিফা বের হয়ে আসে। পরে নিজের বাড়ি থেকে ঈশা খলিফা একটি টিনের ট্রাংক ও পলিথিন নিয়ে ও কক্ষে যায়। এরপর সোহেল ও ঈশা নিহত তপু হোসেনের মরদেহটি ট্রাংকের মধ্যে ভরে রাখে। এরপর সোহেল ওই কক্ষে ঘটনার দিন থেকে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত থেকে পরের দিন বাড়ি চলে যায়। এদিকে জয় সুকৌশলে হত্যাকান্ডের ঘটনাকে অপহরণ বলে চালানোর জন্য অপর ছাত্রের চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন থেকে তপু হোসেনের বাবা আবুল কাশেমের নিকট থেকে মুক্তিপন হিসেবে ৩০ হাজার টাকা বিকাশে চাওয়া হয়। ছেলের বিপদের কথা ভেবে বাবা আবুল কাশেম ওই নম্বরে খরচসহ ৭ হাজার টাকা বিকাশ করে। এরপরই ফোন নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়। আর ফোনটি দাশুড়িয়ার একটি জঙ্গলময় বিপদজনক পুকুরে ফোনটি ফেলে দেয় জয়। থানা সুত্রে জানা যায়, কিশোর তপু নিখোঁজ হলে তার মা মজিরন বেগম বাদী হয়ে গত ১৬ জুন থানায় সাধারণ জিডি করেন। ঈদের ছুটির পর অরণ্য ছাত্রাবাসে ছাত্ররা ফিরে আসে। অরণ্য ছাত্রাবাসের ৩০৪ নং কক্ষের থাকা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ৩য় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মোঃ তানভির আহমাদ পাশের কক্ষ থেকে বের হওয়া দূর্গন্ধ ও রক্ত দেখে ছাত্রাবাসের আয়ার মাধ্যমে মালিকদের খবর দেন। তারা বিষয়টি থানায় জানালে পুলিশ ওই ছাত্রাবাসে গিয়ে তালা ভেঙ্গে কক্ষের ট্রাংকির ভিতরে অর্ধগলিত মরদেহ দেখতে পায়। নিহত তপুর বাবা হত্যা মামলার বাদী মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিক জানান, তার ছেলেকে হত্যার পেছনে মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক দোকানদার মোঃ আলি হোসেন হাসু ও তার মা জড়িত রয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলায় তাদের আসামী করার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের আসামী করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক মোঃ আলি হোসেন হাসু ও তার মা রেনু বেগমকে আসামী না করার জন্য একটি কুচক্রীমহল থানায় জোর তদরিব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার কারণেই মামলায় হাসু ও তার মাকে আসামী করা হয়নি। মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক দোকানদার মোঃ আলি হোসেন হাসু পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, নিহত তপুর বাবার মাথা ঠিক নেই। উনি অনেক অভিযোগই নিয়ে আসতে পারেন। হত্যায় যারা জড়িত তাদের দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ বিষয়ে ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম জানান, নিহত তপু হোসেনের হত্যাকারীদের মধ্যে দুজনকে আটক করা হয়েছে বাকি আসামিদেরকেও গ্রেফতার করা হবে।