পাবনার ভাঙ্গুড়ায় একটি ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশনের পরে লাকি খাতুন (২৫) ও আতিয়া খাতুন (৩০) নামে দুই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। পৌর শহরের শরৎনগর বাজারে হেলথ কেয়ার ক্লিনিকে গত বুধবার ওই দুই প্রসূতির সিজারিয়ান অপারেশন করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খানম। বৃহস্পতিবার রাতে লাকি খাতুন ও শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে আতিয়া খাতুন মারা যান। এ ঘটনায় লাকি খাতুনের পরিবার টাকা নিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করলেও আতিয়া খাতুন পরিবার ক্লিনিক ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
ক্লিনিক ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের রাঙ্গালিয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের মেয়ে ও পার্শ্ববর্তী চাটমোহর উপজেলার মহেলা গ্রামের বাসিন্দা আসাদ আলীর স্ত্রী লাকি খাতুন নয় মাস আগে গর্ভধারণ করলে ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান। সে সময় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খানম তাকে পরামর্শের জন্য ভাঙ্গুড়া হেলথ কেয়ার ক্লিনিকে চেকআপের জন্য আসতে বলেন। এরপর থেকে লাকি খাতুন হালিমা খানমের তত্ত¡াবধানে ফলোআপে ছিলেন। এতে বেশ কয়েকবার ওই ক্লিনিকে করা আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট অনুযায়ী লাকি খাতুনের ২৫ জুলাই সম্ভাব্য সন্তান প্রসবের কথা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি লাকি খাতুনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তার হালিমা খানম তড়িঘড়ি করে ২৮ জুন রাতে সিজারিয়ান অপারেশন করেন। অপারেশনের পরে রক্ত দেয়ার সময় লাকি খাতুন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় পরিবার ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক হালিমা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে বাধ্য হয়ে অচেতন অবস্থায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ লাকি খাতুনকে পাবনা সদর হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে পৌঁছানোর পরেই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এতে বৃহস্পতিবার লাকির স্বজনরা মরদেহ নিয়ে ক্লিনিকের সামনে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এরপর কয়েক ঘন্টা আলোচনা শেষে টাকার বিনিময়ে লাকির পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি দফারফা করে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।
নিহত লাকির চাচা ফারুক আহমেদ বলেন, অপারেশনের পর দিন পরিবারের কাউকে দেখতে না দিয়ে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে ক্লিনিক কর্তৃপ¶ লাকিকে পাবনা সদর হাসপাতালে পাঠায়। এতেই সবার সন্দেহ হয়। এ অবস্থায় পরে বিষয়টি সমাধান হয়। এসময় তিনি আলোচনার মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সমাধানের বিষয়টিও স্বীকার করেন। এ কারণে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন না বলে তিনি জানেন।
লাকির স্বামী আসাদ বলেন, আমার স্ত্রীর তেমন কোন গুরুতর শারীরিক সমস্যা ছিল না। এরপরেও কিসে থেকে কি হলো বুঝলাম না।
অপরদিকে একইদিন লাকি খাতুনের অপারেশনের আগে উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের পূর্ব রামনগর গ্রামের মোতালেব হোসেনের স্ত্রী আতিয়া খাতুনকে ওই ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করেন চিকিৎসক হালিমা খানম। অপারেশনের পরে আতিয়া খাতুন জ্ঞান হারালে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। এর আগে পরিবারের সদস্যরা হালিমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সেখানে গত চার দিন ধরে আতিয়া খাতুন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে মারা যান। পরিবারের অভিযোগ চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় আতিয়া খাতুনের মৃত্যু হয়েছে।
আতিয়া খাতুনের দেবর মোন্নাফ অভিযোগ করেন, সন্ধ্যার সময় অপারেশনের কথা বলে রাত দুইটায় পাবনা থেকে এসে তড়িঘড়ি করে অপারেশন করেন চিকিৎসক হালিমা। এরপরে জ্ঞান হারানোয় হালিমা খানমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। পরে রাজশাহীতে পাঠায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে চিকিৎসক ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হবে।
হেলথ কেয়ার ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিদুল ইসলাম বলেন, এগুলো দুর্ঘটনা। লাকির পরিবার ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে লিখিত দিয়ে মরদেহ নিয়ে গেছে। অপরটি মারা যাওয়ার কথা শুনেছি।
অপারেশনের সময় অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা চিকিৎসক ফুয়াদ ইসলাম খান বলেন, ওটিতে কোন সমস্যা ছিল না। ব্লাড দেয়ার সময় লাকি খাতুনের সমস্যা হতে পারে। আর আতিয়া খাতুনের হার্টের সমস্যা ছিল। কিন্তু হার্টের রোগের কোন চিকিৎসা ক্লিনিকে নেই। এক্ষেত্রে দুজনকেই বাইরে পাঠানো ছাড়া উপায় ছিল না।
এ বিষয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের করা চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খানম বলেন, অপারেশন সঠিক ছিল। কোন সমস্যা ছিল না। লাকি খাতুন লিভার পেইন নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হয়। এক্ষেত্রে এক মাস বাকি থাকতেই প্রসূতির অনুরোধেই অপারেশন করি। আর আরেক প্রসূতি আতিয়া খাতুন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে ফোনে না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ঘুমিয়ে থাকার কারণে তিনি ফোন রিসিভ করতে পারেননি।
তবে প্রশাসনিক ভাবে তিনি দুটি মৃত্যুর কারণ খতিয়ে বের করতে তদন্ত করবেন বলে জানান।
পাবনা সিভিল সার্জন ডাক্তার মনিসর চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।