শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১০:২৯ অপরাহ্ন

ই-পেপার

দুর্ঘটনা রোধে চতুষ্পদ প্রাণির আইন মান্য করা ও কিছু কথা

এম এ মাসুদ, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২, ৫:৩১ অপরাহ্ণ

প্রতিদিন সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু এখন নিত্য ঘটনা। টেলিভিশন কিংবা পত্রিকার পাতা খুললে বা দেখলে সড়ক দুর্ঘটনার খবর দেখে বিষণ্নতা পেয়ে বসে মানুষকে।

যান্ত্রিক যুগের মানুষ ধেয়ে চলছে যান্ত্রিক গতিতে। সেই যান্ত্রিক যানের তলায় পড়ে আবার জীবনও দিতে হচ্ছে তাকে। কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটোছুটি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, যন্ত্র দানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে সেই আবিষ্কারক মানুষকে। মানব সভ্যতায় এ যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যময় চিত্র।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের করা এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৪০৭টি। এর মধ্যে ১৮২টিই মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা। আবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।

এতে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন, আর ৭৯৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ৬২ ও শিশু ৭৭ জন। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৩ পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৩ জন, অর্থাৎ ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। এছাড়া ঢাকায় ২৯টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬২ শি¶ার্থী নিহত হয়েছেন। শি¶ক নিহত হয়েছেন ১৪ জন। এছাড়া দুর্ঘটনায় ১৯ থেকে ৬৫ বছর বয়সি কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন, অর্থাৎ ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

একই সময়ে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৮ জন নিহত এবং তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। ২১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবে¶ণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৪টি (৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ) গ্রামীণ সড়ক এবং ৩৬টি (৮ দশমিক শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্য স্থানে ৬টি ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

চলতি বছরের ৯ জানুয়ারিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ৫৩৭১ টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬২৮৪ জন এবং আহত হয়েছে ৭৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন শিক্ষার্থী। যাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং কিশোর ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো ও আইন না মানা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে যাতায়াত ব্যবস্থার। মহাসড়কগুলো হচ্ছে ফোর লেন এবং জেলা ও উপজেলার রাস্তাগুলোর হচ্ছে প্রশস্তকরণ। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তাও। সব মিলিয়ে যেন নান্দনিক হয়ে উঠছে দেশের সড়ক, মহাসড়কগুলো। কিন্তু দুঃখজনক হলো তারপরেও কমছে না সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। রাস্তায় বের হলে মৃত্যু ভয় যেন তাড়া করছে মানুষের মনকে। আইনশৃংখলা বাহিনী রীতিমতো যুদ্ধ করেও হিমসিম খাচ্ছে সড়কে প্রাণহানী ঠেকাতে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ সংহার হচ্ছে তাদেরও অনেকের। প্রতিনিয়ত সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃতের মিছিল। সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ এবং কারণগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটির সাথে অন্যটি জড়িত। এটি যেহেতু নগর সভ্যতার ভয়াবহ চিত্র, তাই দুর্ঘটনার সাথে নাগরিক সমস্যা জড়িত। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। তারা যখন স্টিয়ারিংটা ধরেন তখন যেন রাজা বনে যান। গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকলেও তারা তা মানতে চান না। এমন কী মদ্যপ অবস্থায়ও গাড়ি চালান কেউ কেউ। ফলে জরুরি অবস্থায় তাৎ¶ণিকভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। আবার প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানোর জন্যও ঘটে অনেক দুর্ঘটনা। ওভার টেক করে আগে যাওয়ার প্রবণতাও সড়ক দুর্ঘটনার কম দায়ী নয়।

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়াও সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ। আইন থাকলেও কী পথচারী, কী চালক কেউই মানতে চায় না সেই আইন। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো, পার্কিং, মাঝপথ দিয়ে গাড়ি চলা, রাস্তার ধারে আড্ডা দেওয়া, রাস্তার ধারে হাট বা দোকান বসানোসহ নানাবিধ কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। আবার, দেখা যায় চালকের আসনে হেলপারকেও বসতে। এমন অদ¶ লোকও যদি গাড়ি চালায় তবে দুর্ঘটনা রুখবে কে?

সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত হচ্ছে, কেউ পঙ্গু হচ্ছে। আবার কেউ বা প্রাণটাই হারাচ্ছে অকালে। এর সুদূরপ্রসারী ফল গিয়ে পড়ছে গোটা পরিবারের ওপর। নেমে আসছে দুুঃসহনীয় যন্ত্রণা। মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর। এমন করুণ মৃত্যু থেকে উত্তরণ পেতে হলে- উৎকোচের বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম ও হয়রানিটা বন্ধ করতে হবে, মেনে চলতে হবে ট্রাফিক আইন, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আইনের প্রতি, কঠোর করতে হবে ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ, নিশ্চিত করতে হবে আইন অমান্যকারীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও হেলমেট পরিধান করা। বন্ধ করতে হবে মোবাইলে কথা বলা ও হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা। এছাড়া পরিহার করতে হবে প্রতিযোগিতা, ওভারটেকিং ও ফাঁকা থাকলেও মাঝপথ দিয়ে গাড়ি চালানো।

প্রচার চালাতে হবে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কীভাবে রাস্তায় হাটতে হয় বা রাস্তা পার হতে হয় তাও অনেকে জানে না। তা জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় গাড়ি, বাইক চালাতে গিয়ে নিজেকে যেন রাজা না ভাবি। বাসায় প্রিয়জনরা যে অধীর আগ্রহ নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বেমালুম ভুলে যাচ্ছি তা। আইন থাকলেও তা মানছি ক’জন! আমরা আইন না মানলেও জীবন বাঁচাতে ও দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা পেতে, নিরাপদ থাকতে আইন যে মানতে হয় তা সৃষ্টির নিকৃষ্ট প্রাণি হয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে একটি কুকুর। খুলে দিয়েছে আমাদের চোখ।

গতকাল দুপুর বারোটার দিকে নাটোর স্টেশন বাজার সংলগ্ন রেলগেটে দাঁড়িয়েছিলেন সংবাদকর্মী নূরুল ইসলাম নূরু ভাই। এ সময় নাটোর রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে রাজশাহী থেকে এসে থামে উত্তরা ট্রেন আর অপর আরেকটি ট্রেন ঢাকা অভিমুখে স্টেশন ত্যাগ করার অপেক্ষায় ছিল। সঙ্গত কারণে ওই রেলগেট বন্ধ থাকে প্রায় ১০ মিনিট। ঠিক এমন সময় পার হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও ঝুঁকি নেয়নি একটি কুকুর। আইন মেনেই লোকজন ও বিভিন্ন যানবাহনের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে। অথচ সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও এক আরোহী আইন ভঙ্গ করে তার বাইসাইকেলটি হেলিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে পার হচ্ছেন ওই প্রতিবন্ধক। ছবিতে দেখা যায়, এক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, আরো এক সাইকেল আরোহী এবং বাইক চালক বাইক নিয়ে নিয়ম ভঙ্গ করছেন গেট বারের ভিতরে প্রবেশ করে। ট্রেন রেলগেট অতিক্রম করার পর গেটম্যান বারটি তুলে নিলে তবেই কুকুরটি রাস্তার বাম দিক দিয়েই রেল লাইন পার হয়। নিকৃষ্ট প্রাণি হলেও কুকুরের আইন মান্য করা এবং সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আইন ভঙ্গ করার দৃশ্যটি ধারণ করতে ভুলে যাননি সাংবাদিক নূরুল ইসলাম নূরু ভাই। আর ধারণকৃত ছবিটি সহকর্মী খাদেমুল ইসলাম ‘এই নাটোর’ পেজে শেয়ার করেন। কুকুরের আইন মানা আর মানুষের আইন ভঙ্গ করা নিয়ে কুকুরের প্রশংসা করেছেন অনেকেই।
যাই হোক, সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাগুলো যাতে না ঘটে সেদিকে সকলের দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। কুকুরের মতো প্রাণির আইন মেনে চলার এমন দৃষ্টান্ত দুর্ঘটনা রোধে আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা।

এম এ মাসুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা।
মোবাইল-০১৮৭৭-২৯২৩১৫
তারিখ- ০৪-১০-২০২২ ইং।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com