বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতা মহা সংকটপূর্ণ একটি পেশা। এখানে অনুকূল বলতে প্রায় কিছুই নেই। মাঠে নামলে শত্রু, পুলিশ শত্রু, রাজনৈতিক দলগুলো শত্রু, ধর্মান্ধরা শত্রু, আর ভূমিখেকো কিংবা দূর্নীতিবাজরা তো চেনা শত্রু । মোটকথা সাংবাদিকতা যেচে পড়ে শত্রুতা বানানোর একটি মাধ্যম বটে। এখানে সাংবাদিকের জীবনের নিরাপত্তা, পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তা কেওই দেয়না। অথচ দিনশেষে একজন সৎ সাংবাদিক জনগণের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। দেশ ও জনগণের জন্য লড়ে যাওয়া একজন নিঃস্বার্থ সৈনিক। কিন্ত প্রশ্ন হলো তারপরও আমরা প্রতিনিয়ত রংবেরংয়ের সাংবাদিক দেখি চারিপাশে। এতো ঝূকির পরও কিন্ত সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়ছে, কমছে না। এখানে মূল ফ্যাক্ট হলো কতোজন আসলে প্রকৃত সাংবাদিকতা টা করছে। শুধুমাত্র ভুঁইফোড় বা ভুয়া গণমাধ্যমই নয় দেশের কথিত শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে কর্মরত অনেক সাংবাদিককেও স্বার্থান্বেষী কিংবা বিভিন্ন অপরাধে জড়াতে দেখেছি। পুলিশের মধ্যে একটা প্রবনতার অভিযোগ প্রায়ই আসে সেটা হলো আর্থিক সুবিধা নিয়ে অপরাধীর পক্ষ নেয়া, সে হিসেবে অনেক সাংবাদিকও খবর প্রকাশের চেয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়ে পরম যত্নে খবর ধামা চাপা দেয়ায় খুব আগ্রহী। অথচ তথ্য গোপন নয় তথ্য প্রকাশই সাংবাদিকতার ধর্ম। আবার একই সময় অনেক সৎ সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ কিংবা সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। যার কোন বিচারই হচ্ছে না।
মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় নেয়া হচ্ছে না কোন উদ্যোগ। যদিও বাংলাদেশে সাংবাদিকদের অজস্র সংগঠন রয়েছে কিন্ত তারা সবাই ব্যক্তি ও সংগঠনের স্বার্থ নিয়েই অধিক ব্যস্ত সময় পার করাটাকেই লাভজনক মনে করে থাকে! বাংলাদেশে চরম বাস্তবতা হলো এদেশে গণমাধ্যমের স্বপক্ষে তেমন কোন আইন না থাকলেও গণমাধ্যমকে আটকাতে, গণমাধ্যমকে ছোট করতে আইনের অভাব নেই। যে সে যখন তখন হুমকির সুরে বলে ফেলে ক্যামেরা বন্ধ করুন! সাংবাদিকের ক্যামেরা হুমকির মুখে বন্ধ হবে কেনো? যদি আপনি বেআইনি কিছু না করেন এ ক্যামেরাকে তো আপনার ভয় পাবার কিছু নেই….! অথচ প্রশাসন, সরকারি দল, বা বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা সাংবাদিকদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী যেকোনো ব্যক্তি দেশের হালচাল জানতে সংবাদ মাধ্যমেই চোখ রাখেন৷ কিন্ত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আর সম্মানের প্রশ্নেই তাদের যতো গড়িমসি! সংঘর্ষের বা যেকোনো অপকর্মে ফুটেজ ধারণ করতে গিয়ে যে সাংবাদিকটি হামলার শিকার হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঐ সাংবাদিককে নিরাপত্তা না দিলেও অপরাধী সনাক্তে ঐ ভিডিও ফুটেজই কিন্ত ভরসা। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কি? তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল পেশায় কর্মরতদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য বিদ্যমান থাকলেও এতো সংকটের পরও সাংবাদিকদের মধ্যে পারস্পরিক কাঁদাছোড়াছুড়ি, অশ্রদ্ধা, হিংসা, অহংকারবোধ, লোভ, এমনসব ধংসাত্মক গুণাবলি দিন দিন বেড়েই চলছে। এমনকি কয়েকদিন আগে একটি প্রেসক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাংবাদিকদের দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াও দেখা গেছে৷ প্রেসক্লাবের নিয়ন্ত্রণ যেখানে একছত্রভাবে সাংবাদিকদের হাতে থাকার কথা, স্থানীয় পর্যায়ে প্রেসক্লাব পৃথক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার কথা, সেখানে কতিপয় সাংবাদিকদের চাটুকারিতার ফলাফলসরুপ প্রেসক্লাব এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতের পুতুল। নবীনদের জন্য তিরষ্কার, প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সাংবাদিকতার উন্নয়নে অনেক প্রেসক্লাবে নেই কোন আয়োজন। যুগ যুগ ধরে ২০-২২ জন লোকই ঘুরে ফিরে নিয়ন্ত্রণ করে যান সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠান । এমনটা চলছে প্রায় সর্বত্রই। পরস্পরকে ছোট করার এই হিংস্র মনোভাব দিনশেষে এ পেশার সবাইকেই হয়তো ছাটাই করে দেবে!
শেষমেশ যে কথা বলতে চাচ্ছি তা হলোঃ সাংবাদিকতা শব্দটা যতোটা সহজ মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটা অতোটা সহজ কোন বিষয় নয়। যেকোনোভাবে কোন গণমাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে আপনি সাংবাদিক তকমা তো লাগাতে পারবেন হয়তো সহজেই কিন্ত প্রকৃত সাংবাদিক হতে গেলে আপনাকে প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আর শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আপনাকে চ্যালেঞ্জ জয় করতে হবে। সাংবাদিকতা ভিতুদের জন্য মোটেও নয়, সর্বদা সাহসী মনোভাব নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে৷ নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে হতে হবে যথেষ্ট কৌশলী। মাঠপর্যায় চষে বেড়াতে হবে, তৈরি করতে হবে নিজস্ব সোর্স নেটওয়ার্ক, মিশতে হবে ধনী-গরিব সবার সাথে, যেকোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে। যতো বেশী সম্ভব তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহে মনোযোগী হতে হবে। কতো বড় গণমাধ্যমে কাজ করেন এটা নয় বরং যে সাংবাদিকের পার্সোনাল ডাটাবেজ যতো বড়, সেই সাংবাদিক ততবেশী শক্তিশালী।
গলায় কার্ড আর কাধে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরলে হয়তো সাংবাদিক হওয়া যায় কিন্ত প্রকৃত, সৎ, ও সাহসী সাংবাদিকতার তকমা অনেক সাধনা ও পরিশ্রমের পর অর্জন করতে হয়। এ পথে ভরসা দেবার লোকের বিপরীতে ভয় দেখানো বা তাচ্ছিল্যের লোকের সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশী৷ তবুও পিছু হটা চলবে না, দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা, আর এমন সাংবাদিকের সংখ্যাটা যখন বেশী হবে, হয়তো সেদিনই এ পেশায় আসবে সুদিন। আর সে আলো ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মনে রাখতে হবে সাংবাদিকতা আছে বলেই দেশ টিকে আছে। অপরাধীদের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এখনও কিন্ত সাংবাদিকরাই।
লেখকঃ
তরুণ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও নীলফামারী প্রতিনিধি,সাপ্তাহিক নীলচোখ,
প্রচার ও দপ্তর সম্পাদক, প্রেসক্লাব,ডোমার, নীলফামারী।