শীতকাল পেরিয়ে এখন ঋতুরাজ বসন্ত। আর সেই ঋতুরাজ বসন্তের বার্তা ছড়াচ্ছে গ্রামের পথে প্রান্তরে। যেন উদাসী মনে আকাশ পানে চেয়ে আছে সদ্যফোটা বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। ঠিক যেনো দল বেঁধেছে। আম, লিচু ও সজনে ফুলে গ্রামগঞ্চ অপরূপ সৌন্দর্যে সেজেছে।
আম মুকুলের পাগল করা ঘ্রাণ ॥
রঙ্গ ও রূপে নিজেকে সাজাতে আম গাছ নতুন কুঁড়ি ও ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে। মধুমাসের বার্তা শোনাচ্ছে আমের মুকুল। বাতাসে মিশে সৃষ্টি করছে মৌ মৌ গন্ধ। যে গন্ধ মানুষের মনকে বিমোহিত করে। পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতার পংক্তিগুলো এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে। কবি তার পংক্তিগুলোতে বলেছেন, “আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ে যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ”। সুখের ঘ্রাণ বইছে গাছে গাছে ফুটা আমের মুকুল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এই মুকুলের পাগল করা ঘ্রাণ।
আম বাগানে শোভা পাচ্ছে কেবলই মুকুল। এ যেন হলুদ আর সবুজের মহামিলন। মুকুলে ছেয়ে আছে গাছের প্রতিটি ডালপালা। চারদিকে ছড়াচ্ছে সেই মুকুলের সুবাসিত পাগল করা ঘ্রাণ। তবে আমের ফলন নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিকরা।
এ মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মুকুলে ভরে গেছে বাগানসহ ব্যক্তি উদ্যোগে লাগানো আম গাছগুলোতে। দেখা যাচ্ছে বড় আকারের চেয়ে ছোট ও মাঝারি আকারের গাছে বেশি মুকুল ফুটেছে। সেই মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে বাগান মালিকদের চোখে ভাসছে স্বপ্ন। দেশি জাতের আমারে পাশাপাশি ফজলি, আমরূপালি, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপা অন্যতম। ইতিমধে মুকুল ফুলে ভরে গেছে প্রতিটি গাছে গাছে।
চাটমোহর হরিপুর এলাকার গোপালপুরের গ্রামের আবু মুসা তিনি বলেন, এবার প্রায় ৩ বিঘা জমিতে আমচাষ করেছেন। আশা করছি ভালো ফলন পাবো। এছাড়াও উপজেলার কয়েকজন বাগান মালিক জানান, তাদের বাগানে লাগানো আম গাছে মুকুলে ভরে উঠেছে। আর কিছু দিন পরেই কলি আসবে। বিগত বছরের ছেয়ে এবছর বেশি ফলন হবে আসা করছি।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুয়ারী, উপজেলায় ৬শ’ ১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে। এ থেকে প্রায় ১০ হাজার মেট্টিকটন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
লিচুর বাগানে মুকুল উঁকি দিচ্ছে, বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা ॥
চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক বাসাবাড়ির আঙিনায় লাগানো হয়েছে লিচু গাছ। ফাল্গুনে লিচু গাছের লাল-সবুজ পাতার মাঝে সবুজ ডগায় মুকুল এসেছে। এতে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। ফাল্গুনের শেষ ভাগে কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এখনো ৩০ শতাংশ লিচুগাছে মুকুল আসা বাকি। লিচু চাষীরা এখন লিচু বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত। লিচু গ্রাম বলে খ্যাত উপজেলার গুনাইগাছা, রামচন্দ্রপুর, মন্ডলপাড়া, বড় শালিখা, জালেশ্বর সহ আশপাশের গ্রামের বাগানগুলো লিচুর মুকুলে ছেয়ে গেছে। এছাড়াও উপজেলার হরিপুর, ধরইল, বোঁথর, মথুরাপুর, খয়েরবাড়িয়াসহ অন্যন্য এলাকার গাছগুলোতে লিচুর মুকুল উঁকি দিচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার পরবর্তী আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গত মৌসুমের মতোই লিচুতে লাভবান হবেন কৃষকেরা। এবার লিচুর হার্ভেস্টিং ঈদুল ফিতর কাছাকাছি সময়ে পড়বে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে রমজান মাসের শেষ ভাগে ইফতারিতে দেখা মিলবে টসটসে রসাল লিচুর, এমনটিই জানাচ্ছেন চাষিরা।
চাটমোহর মূলগ্রাম এলাকার চাষী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রতিটি গাছেই লিচুর মুকুল এসেছে। এ উপজেলায় চাষ হয় চায়না থ্রি, বোম্বাই, কাঁঠালি ও স্থানীয় জাতের লিচু। তিনি আরও বলেন, গত মৌসুমে লিচু চাষিরা লিচু বিক্রি করে যথেষ্ট লাভবান হয়েছিলো। এবার আরও বেশি লাভবান হবার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উপজেলার সব এলাকায় কমবেশি লিচুর চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় রামচন্দ্রপুর, জালেশ^র, গুনাইগাছা, মন্ডলপাড়া, হরিপুর, ধরইল, ধুলাউড়ি, বড় শালিখা, বড় গুয়াখড়া এবং মূলগ্রামে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, উপজেলায় প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুবাগান রয়েছে। এছাড়াও বসতবাড়ির উঠানসহ বাড়ির আশপাশেও অনেক লিচু গাছ আছে। এ উপজেলায় গত বছর প্রায় ৩ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়েছে বলে কৃষকরা জানান।
লিচু চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, ৩০ গাছ নিয়ে একটি বাগান আছে তাঁর। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা এখন বাগান কেনার জন্য আসছেন। মুকুল দেখেই তারা বাগান কিনছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ. এ. মাসুমবিল্লাহ বলেন, মুকুল ছাড়ার আগে গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া হলে কিংবা বিষ প্রয়োগ করলে গাছ কচিপাতা ছাড়ে। মুকুল থেকে গুটি হতে শুরু করলে হপার পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে একবার বিষ প্রয়োগ করতেই হয়। মুকুল দেরিতে এলেও ফলন সন্তোষজনক হবে বলে আশা করছেন তিনি। চাটমোহরে প্রতিবছরই লিচুর আবাদ বাড়ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
শুভ্র ফুলে ভরে গেছে “মিরাকেল ট্রি” খ্যাত সজনে গাছ ॥
বসন্ত কালে নতুন রূপে নিজেকে সাজাতে পিছিয়ে নেই সজনে গাছ। ভরে ওঠে শ্বেত শুভ্র ফুলে। সজনে ফুলের রূপ পথচারিদের দৃষ্টি কাড়ছে। সজনের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি উপাদান থাকায় এগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জীবন ধারণের পুষ্টির যোগানও দেয়। এর শিকড়ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। নিম পাতার চেয়েও বেশি ওষুধি গুনাগুণ থাকে সজনে পাতায়। এটি সহজলভ্যও বটে। প্রাণী খাদ্য হিসেবেও সজনে পাতা ব্যবহৃত হয়।
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত বৃক্ষ সজনে গাছ। বসত বাড়ির আঙিনা, রাস্তার আশ পাশে অবহেলা, অনাদরে সজনে গাছ বেড়ে ওঠে। গাছের মালিককে এর পরিচর্যা করতে হয়না বললেই চলে। বছরে একবার সবজির জোগান দিলেও সারা বছর শাক হিসেবে এর পাতা পাওয়া যায়। সবজি হিসেবে সজনের কচি ডাটা যেমন উপাদেয় এবং পুষ্টিকর তেমনি এর পাতাও ওষুধি গুনে ভরপুর। তাই গবেষকরা সজনে পাতাকে নিউট্রিশন্স সুপার ফুড এবং সজনে গাছকে মিরাকেল ট্রি বলে অভিহিত করেন।
চাটমোহর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, সজনে গাছ খরাসহিষ্ণু গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিল মাসে ডালের মাধ্যমে সজনে গাছের বংশ বিস্তার করানো হয়।