নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়ে নাটোরের বাগাতিপাড়ার চকগোয়াশ গ্রামের আব্দুস সালাম ও মাজেদা বেগম দম্পতির মেয়ে মনিরা খাতুন এবার উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছেন। মাধ্যমিকেও একই ফল ছিল মনিরার। তবে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদিকে একই সমস্যায় পড়েছে জেলার লালপুর উপজেলার মতিউর রহমান ও ফাহিমা খাতুন দম্পতির মেয়ে মেরিনা খাতুন। এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েও অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন অনিশ্চিত তারও। তার ছোটবেলায় বাবা মতিউর রহমান তার মা ফাহিমা খাতুন তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে, এতে ক্ষতি হয় তার। বাবা-মায়ের অন্যত্র বিয়ে হলে অভিভাবকহীন মেরিনা বৃদ্ধ নানা-নানীর সাথে বসবাস করেন। তার নানা লালপুর উপজেলার কলসনগর গ্রামের পাতান শেখ। পাতান শেখের ছোট্ট একটি টিনের ঘরেই নানা-নানীর সাথে মেরিনার বসবাস।
মনিরা বাগাতিপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়েছেন। এর আগে উপজেলার তমালতলা আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে একই ফল পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়া। মনিরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে চান। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে কি না, সেই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
অপর দিকে, অদম্য মেধা ও ইচ্ছা শক্তিকে পুঁজি করেই দারিদ্র্যতার করাল গ্রাসে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে অন্যের কাছ থেকে বই সংগ্রহ আর অন্ধকার ঘরে কুপির আলো জ্বেলে লেখাপড়া চালিয়ে কলস নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসিতে ও কলসনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকল বিষয়ে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করে সে। এরপর তার মনোবল আরও বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৯৬ ও ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অদম্য মেধাবী মেরিনা বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। দাঁড়াতে চায় নিজের পায়ে। টিনের ঝুপড়ি ঘরে পরিবারের ৩ সদস্যের বসবাস হওয়ায় লেখাপড়া করার মতো পর্যাপ্ত জায়গাটুকু মেলেনা তার। তবুও নিজের অদম্য ইচ্ছা আর নানা-নানীর ভালোবাসায় লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু আগামী দিনে পড়ালেখার খরচ বহনের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে পরিবার।
বাগাতিপাড়ার মনিরা খাতুন বলেন, যত কষ্টই হোক, পড়ালেখা করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন, এটা তিনি সংকল্প করেছেন। বড় হয়ে নিজের পরিবারের পাশাপাশি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন।
লালপুরের মেরিনা জানায়, তিন বেলা খাবার জোটানোই নানা-নানীর পক্ষে কঠিন ব্যাপার। সেখানেতো লেখাপড়ার বিষয়টি বড় কষ্টকর। তবুও নানা-নানীর স্বপ্ন আমাকে লেখাপড়া করানোর। খুব কষ্টে দিন কাটে আমাদের। তবুও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাই। বড় হয়ে একজন বিসিএস ক্যাডার হবো, এটাই আমার স্বপ্ন। ক্লাস ওয়ান থেকে এখন পর্যন্ত সব ক্লাসেই মেধা তালিকায় প্রথম অবস্থানে থাকি। সবার দোয়া থাকলে তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে।
তমালতলা আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শি¶ক নাজনীন সুলতানা বলেন, ‘অত্যন্ত মেধাবী মনিরা দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেও অভাবী সংসারে কষ্ট করে লেখাপড়া করে ভালো ফল করেছে। দোয়া করি, সে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজের সেবা করে।’
সাফল্যের ব্যাপারে কলস নগর মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জাবেদ আলী জানান, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মেরিনা খাতুন। সে অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান। আরও সুযোগ-সুবিধা পেলে সে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। আমরা আমাদের কলেজে থাকা অবস্থায় তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছি। কিন্তু তার উচ্চ শিক্ষা এখন একটি অনিশ্চিত ব্যাপার। সমাজের বিত্তবানরা যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে সে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
#চলনবিলের আলো / আপন