বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৭:৪২ অপরাহ্ন

ই-পেপার

কদম তলা – নাহিদ ইসলাম দোলন 

প্রতিনিধির নাম:
আপডেট সময়: শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১০:৫০ অপরাহ্ণ

বোশেখের শেষাশেষি,
নারকোলের চিরল চিরল পাতার ফাঁকে যখন সূর্যের ঝিরিঝিরি আলোর প্রলেপ দেখা যায়, ডুমুরের কচি পাতায় টুনটুনির ছোটাচ্চু বাচ্চাদের কিচিরমিচির শব্দ তখন দুই বোনের ঘুমের আড়মোড়া ভাঙ্গাতে দেরি করে না। সকালের মৃদুমধুর  শব্দগুলো ওদের কর্ণ উপেক্ষা করে না। তুলি ঘুম মিশ্রিত চোখে বাইরে তাকিয়ে আবারও ঘুমানোর আয়োজন করে। নিতু বলে, দিদি,ওঠ্ না.. ও দিদি?  কত্ত বেলা হয়েচে।
নিতু প্রত্যহ তুলিকে অন্যরকম একটা মেয়ে হিসেবে আবিষ্কার করে, সে মেয়ে শান্ত গোছের। ধীর স্থীর। বাঁশের বেড়া ভেদ করে আলো তুলির মুখের ওপর পড়ে,ভারী অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে দিদিকে। তুলির মলিন কাপড়ে একটা গন্ধের রেশ পাওয়া যায়, ঝাঁকড়া চুল বালিশে এলোমেলো হয়ে থাকে। নিতু আবার হাত ধরে টানে, দিদি-ই-ই..
তুলি ওঠে পড়ে, দুইজনে পুকুরপাড়ে হাত মুখ ধুতে যায়,অন্যথায় মায়ের বকুনিতে সারা বাড়ি উদ্ধার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
পুকুরপাড়ে এতক্ষণে সূয্যির ভীষণ তেজ পরিলক্ষিত হয়।  দুই বোন তাদের অতিশয় নিষ্প্রয়োজনীয় কাজের তালিকা মাথায় গুঁজে নেয়। এদিকে বেলতলা হতে মা ডাকে, নিতু, নিতু -উ-উ-উ…তুলি ও তুলি, এসো দিকি, মুড়ি ভেজেচি,খেয়ে উদ্ধার করো দিকিনি।
নিতু রান্নাঘরে জ্যোতিরাণীর শরীর ঘেঁষে পিড়ি পেতে বসে, উৎসুক হয়ে উনুনের ওপর ভাঙা কড়াই টার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এদিকে তুলি চোখের ইশারার নিতুকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে, হয়তো কাল যে কদম তলায় একটা পাখির বাচ্চার সন্ধান পেয়েছিল,সেটার জানান দিতে চায়। নিতু একবার মায়ের দিকে আরেকবার দিদির দিকে তাকিয়েই তার দায়িত্বের ইতি টানতে চায়। তার মধ্যে একটু চপলতা পরিলক্ষিত হলেও মায়ের বকুনির কথা ভেবে মুহূর্তেই সেটি ভয়ের রূপ পরিগ্রহ করে।
কদমতলায় বসে বাঁশের কঞ্চির আঘাতে কচুপাতায় সপাৎসপাৎ শব্দ করে। এতে বেশিরভাগ কচুগাছই মস্তকহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। গোবরে শালিকের বাচ্চা পারার ভাবনায় সে নিমজ্জিত হয়।  নিতু দৌঁড়ে এসে হাজির হয়, আজ যে তারা পাখির বাচ্চা পেরে অসাধ্য সাধন করবে, এটা ভেবেই দুই বোনের মুখে বিজয়ের আলোর ঝলকানি দেখা যায়।
নিতু, চল্, শ্যামলীদের বাগান থেকে কামরাঙ্গা পেরে আনি।
কিন্তু দিদি, ওগুলো তে কেবল তো মাত্র ফুল….কথাটা শেষ করার সাহস হয় না,চুপ করে যায়।  দোষ এড়াতে দিদিকে কামরাঙ্গার গুণাবলি সাগ্রহে ব্যক্ত করতে থাকে। তুলি একটা কিল বসিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যত হলেও কী একটা ভেবে নিতুকে হেঁচকা টান দেয়। কামরাঙা খেতে চাস বুঝি!! যা অরুণীমাদের বাড়ি থেকে আঁকুশি টা আনগে গিয়ে। আমি দেখি কামরাঙা তলা জনশূন্য কিনা!  নিতু আঁকুশি আনতে গিয়ে মায়ের হাতবন্দী হয়ে যায়,  এতে দিদির কামরাঙ্গা খাওয়ার সাধ চুকে গেল ভেবে নিতু কষ্ট পায়। আসন্ন বিপদ টের পেয়ে তুলি কদম তলায় ফিরে যায়। বুনো বেলী ফুলের মালা গেঁথে নিতুর জন্য রেখে দেয়। ঐশীদের পুকুর তলায় সবাই নাইতে গেলে তুলি পাখির কথা ভেবে কদমতলায় পড়ে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে নিতু ডাকতে চলে আসে,কীরে দিদি? মা আসতে না দিলে আমি কী জোর করতে পারি বল্? এতে অভিযোগের ভিত্তি সে মায়ের ওপর গড়ে তোলে।
হঠাৎ দিদির হাতের বেলীফুলের দিকে দৃষ্টি চলে যায়, ভারী সুন্দর তো! কোথেকে পেলি দিদি?!!
ও দিদি, কামরাঙ্গায় কী মিষ্টি ভাব এসেছে?  তুলি গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিতুর গায়ে একটি কিল বসিয়ে দেয়।আঁকুশী দিয়ে পেড়ে কত্ত খেলাম। নিতু নিজের অপরাধ লুকাতে পাখির বাচ্চার কতা পাড়লেও তুলি কোনো কথা বলে না।
শেষ বিকেলে দুজনে বেলীর মালা  পড়ে চুল নাচিয়ে নাচিয়ে বাড়ির দিকে এগোয়। নিতুর মাঝারি সাইজের চুলে দুইটা বেণী গাঁথা, তবে সেটা দুই কোয়ার বেশি হয় না, মলিন লাল রংয়ের ফিতেয় বাঁধা। জ্যোতিরাণীর মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটছে, ও তুলি! এ বুঝি তোমার বাসায় আসার সময় হলো? বলি কী,আসলে কেন!? লোকের গাছের তলায়,পাড়ায় পাড়ায় না ঘুরলে তোমার বুঝি শান্তি নেই। সংসারের কুটোখড়টা ভেঙে দু টুকরা করা নেই,আপদ চুকে যাবে না আমার কোনোদিন?!
রাতে পিদিমের আলোয় দুবোন মায়ের পাশে বসে থাকে,পিদিমের আলোয় মায়ের মুখখানা উজ্জ্বল দেখায়। ডালের বড়া ভেজেচি,দুবোন খুব করে খেয়ো। লক্ষীসোনা আমার, এভাবে পাড়া বেড়ানি হলে চলে! সাত রাজার ধন আমার। কথাগুলো তুলির কাছে গুরুত্ব পাওয়ার আশা থাকলেও কার্যের পুনরাবৃত্তি থেমে থাকে না। আসি আসি করে বাদলা আসে। চারিদিকে পানি আর পানি। বৃষ্টির ছাটে চারিধার ধোঁয়া ধোঁয়া।  এবার বরষায় খুব মাছ এসেচে,রাস্তায় বড়ো বড়ো পুঁটি। ব্যাংয়ের ডাকে চারপাশ টা অদ্ভুত শ্রুতিমধুর ঠেকে। তুলি বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। শাড়ির আঁচলে কয়েকটা সরপুঁটি মাছ ধরতে সক্ষম হয়। মাকে বলে,ভেজো দিকি,শুকনো মরিচ দিয়ে খাব ক্ষণ। পরের দিন ভোররাত থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়,নারিকেলের ঝাঁকড়া চুল বাতাসে দোল কায়,ইউক্লিপটাস গাছ একে অপরকে আলিঙ্গন করে, জারুল গাছের কান্ড মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
সকাল গড়ালো,বৃষ্টির থামার বালাই নেই।  নিতু মাকে শুধোয়,রান্না হয়েচে? উঁহু, খিদেয় পেটে মোচড় দিয়ে উঠচে। জ্যোতিরাণী এমন কোনো উত্তর দিতে পারে না যা শুনে সে খুশি হতে পারে। জ্যোতিরাণীর নাকে দারিদ্র্যের উৎকট গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। হঠাৎ তুলির চিৎকার শুনে নিতু মায়ের দিকে তাকায়। পানি ভেঙে সামনে এগোতেই চটচটে দূরন্ত মেয়েকে বাঁশঝাড়ের গুড়ির নিকট পড়ে থাকতে দেখা যায়। তুলি বাম পায়ে জোরে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে, মাথা সামনের দিকে উবু হয়ে আছে। জ্যোতিরাণী হাত সরালে বিসর্গের মতো কীসের একটা দাগ দেখা যায়, লাল ভরাট বর্ণের। মা লোক ডাকে,ও দিদি, ও পটলের মা, ও ঠাকুরপো!!  সবাই এসে সাপে কাটা নিশ্চিত করে। তুলির শরীর কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে গেছে। ঝাঁকড়া চুল দুভাগে ভাগ হয়ে মুখের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। নিতু ডাকচে, ও দিদি,ওঠ্ শুনতে পাচ্ছিস? জ্যোতিরানী হন্যে হয়ে কবিরাজ ডাকতে গেচে। সবার মাঝে একটা চঞ্চলতা দেখা গেলেও তা বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তুলির দেহ ক্রমশই নীল হয়ে আসে। নিতুর হাতে থাকা তুলির ডান হাত ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। নিতুর দৃষ্টি তুলির বন্ধ করুণ চোখে নিবদ্ধ হয়।  জ্যোতিরাণী কবিরাজ নিয়ে আসে। পথিমধ্যে বুকটা ধড়াস করে ওঠে।  আঁচল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
কবিরাজ নিরাশ হয়ে ফিরে আসে। আবারও ঝুম বৃষটি।সবাই চলে যায়। তুলির দেহ উঠানে পড়ে থাকে। মাথার দুইপাশে জ্যোতিরাণী ও নিতুর অনড় অবস্থান। বিষটিতে ভিজে একাকার। নিতু মনে মনে শালিকের বাচ্চার কথা ভাবে, এতদিনে হয়তে কামরাঙ্গায় রং ধরেচে। নিতুর বিশ্বাস, দিদি ওঠে বলবে,চল্, কদম তলায় যায়, একথা বলে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে ভাটগাছ পার করে নিজের পথ খুঁজে নেবে,নিতুও পিছন পিছন বলবে,ও দিদি, আর দৌঁড়াস নে,আমি যে আর পারচিনে।
নাহিদ ইসলাম দোলন 
বকশিগঞ্জ সরকারি কিয়ামত উল্লাহ কলেজ
বকশীগঞ্জ, জামালপুর।
#CBALO/আপন ইসলাম


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর