রফিকুল ইসলাম তাড়াইল প্রতিনিধি:
দেশবরেণ্য কুস্তিগীর ফারুকউদ্দিন আহমেদ ফখরুদ্দীনআহমেদ বিশ্বসভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে, তার পেছনে কাজ করছে মানুষের ইচ্ছা, সংকল্প ও আগ্রহ। দৃঢ় ইচ্ছাই কোনো কিছু সফল করার উপায় এনে দেয়। ইচ্ছাশক্তিকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লাগালেই জীবন সফল হয়ে ওঠে। এ জন্য উদ্দেশ্য ঠিক রেখে দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই বলা যায়, যদি আপনার উদ্দেশ্য বা চাওয়াটা নিখুঁত থাকে এবং সে অনুসারে কাজ করা যায়, তাহলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। আর অসাধ্যকে সাধন করা আপনার জন্য হবে সহজ।(তার দৃষ্টান্ত……) আজ আমরা এমন একজন প্রবল আত্মবিশ্বাসী দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ইতিহাসখচিত ক্রীড়া তারকার কথা বলছি যিনি ক্রীড়াজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি হলেন সবার পরিচিত ফারুকউদ্দীন আহমদ। আমাদের এলাকায় তথা পার্শ্ববর্তী উপজেলা সমূহতে তিনি ফারুক মাল নামে সমধিক পরিচি।
ক্রীড়া জগতে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী ক্রীড়াবিদ । তাঁর রয়েছে নানান পরিচিত ও পরিব্যপ্তি। কুস্তিগির, বডিবিল্ডার, ভারোত্তোলক ও বক্সার।তবে কুস্তিগির হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত ও খ্যাতিমান। তিনি শারিরীক দক্ষতার বলে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, শৈশবে কিন্তু শারিরীক গঠন তেমন ছিল না। আমরা যদি তাঁর শৈশবকালে ফিরে যায় তাহলে দেখতে পায় তিনি ছোটবেলায় একদম রোগা পাতলা কঙ্কালসার ছিলেন। বাসায় কোনো আত্মীয় স্বজন আসলে উনার মা খালি গায়ে মেহমানদের সামনে যেতে দিতেন না। খালি গায়ে থাকলে জামা পড়িয়ে তাকে সামনে আসতে দিতেন। বলতে গেলে একরকম সবাই অবজ্ঞা অবহেলা করত। এই অবহেলা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে লাগলেন। ১৯৫৬ সালের কথ। ঢাকায় ফ্রিস্টাইল কুস্তি করতে আসেন পৃথিবীবিখ্যাত কুস্তিগীর আসলা, ভুলু, গোগা, কিংকং, জেভেসকো।
পত্রিকায় তাদের ছবি দেখে তিনি রীতিমতো অবাক। তাদের আগমনে এই স্বপ্নবাজ মানুষটি মনের কোণে স্বপ্ন আঁকলেন তিনিও একদিন…….। সেইদিন থেকে ওই মানুষগুলো তাঁর জীবন ফিল্মের হিরো। তিনি তাঁর মা’র কাছে তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন, মা বলেন — উনারা (কুস্তিগীররা) ভালো খাবার খায়, নিয়মিত ব্যায়াম করেন। আর এজন্যই তাদের শরীর সুন্দর ও সুঠাম। মায়ের মুখে এ কথা শুনে তিনি খুবই আনন্দিত ও উৎসাহিত হন। তখন মনস্থির করেন তিনিও তাদের মতো হবেন। তখন তাঁরা বাবার চাকরি সূত্রে রংপুরে থাকেন। উনার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তখনকার রংপুরের বাসার পাশে ডাক বাংলোতে একজন হাবিলদার ব্যায়াম নিয়মিত করতেন। তাঁর কাছ থেকে তিনি ব্যয়ামের উপর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। তখন ধ্যানে, জ্ঞানে ও মনে ব্যায়ামেই তাঁর একমাত্র সাধনা। তবে সেই ব্যায়ামটা তখন তাঁর জন্য সহজ ছিল না। তখন ব্যায়ামের পরিবেশটা তাঁর অনুকূলে ছিল না। পারিবারিকভাবে তখন ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। ১৯৫৮ সালে ঢাকায় আসার পর তিনি পুরোদমে ব্যায়ামের চর্চা শুরু করেন। তবে তাঁর এই ব্যায়াম করাটাকে তাঁর বাবা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। উনার বাবা চাইতেন, তাঁর ছেলে কেবল লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। তাই তিনি তাঁর বাবার অজান্তে চুপিচুপি ব্যায়াম করতেন।
তিনি খুব ভোরে উঠে ব্যায়াম করতে যেতেন। দরজা খোলার সময় শব্দ শুনে উনার বাবা জেগে উঠলে তিনি বাথরুমে লুকিয়ে থাকতেন। বাবার ন্যায় মাও চাইতেন না, তিনি ব্যায়াম করেন। কারণ মা’র ভয় ছিল, না জানি কখন হাত পা ভেঙে যায়। আর এ কারণেই মা আজিমপুর কলোনি থেকে পল্টনে যাওয়ার ৯পয়স বাস ভাড়া দিতেন না। তখন ওনারা আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন। তিনি আজিমপুর ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে পড়তেন। তখন ১৯৬০ সাল। পল্টনে তখন কুস্তি শেখাতেন পাকিস্তানের বিখ্যাত কুস্তিগীর চৌধুরী মোহাম্মদ আশরাফ। পাকিস্তান কুস্তি ফেডারেশন তখন তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ছেলেদের কুস্তি শেখানোর জন্য নিয়োগ দেন। বিভিন্ন স্কুলে তখন সার্কুলার দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তাদের স্কুলেও সেই সার্কুলার আসলো। ক্রীড়া শিক্ষক আমীর আলী স্যার বললেন, ফারুক তুই তো ব্যায়াম করিস। তুই এই কুস্তি প্রশিক্ষণে অংশ নে। ওই স্যারের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি কুস্তি প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করেন। স্কুল ছুটির পর এই প্রশিক্ষণ হতো।
যাতায়াতের ৯ পয়সা বাস ভাড়া মা না দেওয়াতে তাঁর খুবই কষ্ট পোহাতে হয়। স্বল্প সময়ে অল্প বয়সে তিনি কুস্তিতে বেশ বাজিমাত করে ফেললেন। একের পর এক বাঁধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে, চেষ্টা ও শ্রম বিনিয়োগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবােটাবাদে আয়োজিত হয় পাকিস্তান সিভিলিয়ান রেসলিং কোচিং ক্যাম্প। ৬ সপ্তাহের এই ট্রেনিংয়ে পাকিস্তানের প্রতিভাবান কুস্তিগিররা অংশ নেন। সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বোর্ড পূর্ব পাকিস্তান যে, চারজনকে নির্বাচিত করেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্য তিনজন হলেন, আলী ইমাম, ফজলুর রহমান ও নুর মোহাম্মদ।