মহামারি করোনাভাইরাসের তান্ডবে বিধ্বস্ত পুরো বিশ্ব। জীবন হারিয়েছে তার স্বাভাবিক গতি। এখন আর আগের মতো হুটহাট করে চাইলেই ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না। কিন্তু মানবিকতার বীজ যাদের মধ্যে রোপিত হয়ে গেছে, যারা শত দুর্যোগ-মহামারি-ঝড় -ঝঞ্ঝাতেও মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পিছপা হন না-সেই মানবতার ফেরিওয়ালারা সত্য-মিথ্যা বলে যেভাবেই হোক পরিবারকে ম্যানেজ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানবসেবায়। এতেই তাঁরা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান। প্রকৃতপক্ষে মানবসেবাই পরম ধর্ম। মানবসেবায় রয়েছে জীবনের আসল সার্থকতা।
গত ২৪ জুলাই সন্ধ্যার প্রাক্কালে সালমান হঠাৎ ফোন দিয়ে বললো- তুই কোথায়? ফোনে তাঁর কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে! আমি জবাব দিলাম- আমি তো সাইকেল নিয়ে বিলোনিয়া চলে এসেছি। করোনায় সারাক্ষণ ঘরবন্দি থাকতে থাকতে মন বিষন্নতায় বিষ হয়ে আছে। তাই প্রশান্তি খুঁজতে বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। মুন্সিরহাট থেকে যেতে যেতে একেবারেই বিলোনিয়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সীমারেখায় চলে এসেছি।
আমি বিলোনিয়া চলে এসেছি বলতেই তাঁর গলা আরো ছোট হয়ে যায়। বিলোনিয়া এত দূর সাইকেল নিয়ে! সে তাৎক্ষণিক বলে উঠলো- হাবিবের চাচাতো বোনের জন্য ইমার্জেন্সি এক ব্যাগ বি পজেটিভ রক্ত লাগবে চট্টগ্রাম মেডিকেলে। তোর তো বি পজেটিভ তাড়াতাড়ি আয়। আমি এ কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম,কি করবো, কি উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছি না। তৎক্ষণাৎ সালমান বলে দিলো সাইকেলটা বাসের ছাদে তুলে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তুই বাড়িতে চলে আয়।
বিলোনিয়া থেকে বেশ দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে পরশুরাম বাজার পর্যন্ত এসে সাইকেলটা তুলে দিলাম বাসের ছাদে। বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে আসলাম। বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকতেই দেখি সালমান আর হাবিব আমার জন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করছে।
ঘরে ঢুকে শুধু মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে যাই গাড়িতে। কারণ মানিব্যাগটাতে আমার সব তথ্য-পরিচয় রয়েছে। আমরা মুন্সিরহাট থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের পথে রওনা দিয়েছি। গাড়ি তার আপন গতিতে চলছে। আর মুঠোফোনে বার বার কল আসছে- কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হতাশ কন্ঠে ভেসে আসছে ‘আমরা কতটুকু এসেছি? আর কতক্ষন লাগবে?’
আসলে বিপদের সময় প্রহর কাটতে চায় না। বিপদের সময় অনুধাবন করা যায় এক সেকেন্ড সময়ের মূল্য কেমন। এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মা ও শিশু ওয়ার্ডে ২০ দিন বয়সী অবুঝ শিশুটা জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ছে শুধু কয়েক ফোঁটা রক্তের জন্য।
পৃথিবীর আলো দেখার দিন থেকেই শিশুটির শরীরে দেখা দেয় রক্তস্বল্পতা। তাঁর রক্তে শ্বেত রক্তকণিকার ঘাটতি দেখা দেয়। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিয়েছেন এতটার মধ্যে রক্ত দিতে না পারলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। জীবন নাশেরও সম্ভাবনা রয়েছে।
অবশেষে আমরা নির্ধারিত সময়ের ঠিক কিছুক্ষণ আগে গিয়ে চমেকে পৌঁছলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে সালমান আর আমার রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। একজনের ক্রসমেসিং এ কোনো সমস্যা হলে বিকল্প হিসেবে আরেক জন থাকবে এ জন্য দুজন যাওয়া।
সেখানে এবার আমরা দু’জন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম কে রক্ত দেবো, কে আগে স্যাম্পল দেবো। আমি বলি- আমি দেবো, সালমান বলে- সালমান দিবে।
আমি জোর গলায় বলতে লাগলাম- আমি এত কষ্ট করে দূর থেকে এসেছি ব্লাডটা আমিই দিই।
সালমান বলছে- তুই আগে অনেক বার রক্ত দিয়েছিস, এবার আমাকে সুযোগ দে। আমাদের দু’জনের রক্তদানের প্রতিযোগিতা দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দুইজনের রক্তদানের প্রতিযোগিতায় আমি হার মেনে নিলাম।
অবশেষে সালমান স্যাম্পল দিলো। ক্রসমেসিং ঠিক আছে, অতঃপর সে ব্লাডটা দিলো। ঘন্টাখানেক পর শুনতে পেলাম ছোট শিশুটা এখন ভালো আছে। খবরটা শুনে আমাদের তিন বন্ধুর সব ধরনের অবসাদ, বিষন্নতা নিমিষেই দূর হলে গেলো। আমাদের ক্ষুদ্র ত্যাগে একটা শিশুর জীবন প্রদীপ নিভে যেতে যেতে আবার আলোয় ফিরে পেল ভেবে নিজেদের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা করছে। যে ভালোলাগা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করার মতো নয়।
কিছুক্ষণ আগেও যে বাবা-মার চোখে মুখে হতাশা আর করুণ চাহনি দেখা গিয়েছিল, সে চোখে মুখে এখন মুগ্ধতা সঞ্চারী বিশ্ব জয়ের হাসি।
মানবসেবায় এক ধরনের আত্মতৃপ্তি রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের হক আদায় করা যায়। মানুষ সামাজিক জীব। সে হিসেবে মানুষের একে অপরের প্রতি রয়েছে কিছু সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। আর এর মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান অন্যতম। রক্তদান একটি মহৎ মানবিক কাজ। আপনার রক্তের মাধ্যমে আরেকজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে এর মতো মহৎ মানবিক কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা হতে পারে না।
রক্তদান সামাজিক প্রীতিবন্ধন মজবুত করে, সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে, এমনকি ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
মানুষের রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বলা হয় ‘করিলে রক্তদান, বাঁচিবে একটি প্রাণ’, ‘আপনার রক্ত দিন, একটি জীবন বাঁচান’, ‘সময় তুমি হার মেনেছ রক্তদানের কাছে, দশটি মিনিট করলে খরচ একটি জীবন বাঁচে।’
আমাদের দেশে দেখা যায়, রক্তদানে অনেকেই ভয় পান। কেউ কেউ ভাবেন এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, দুর্বল হয়ে পড়বেন বা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বেন। কেউ আবার মনে করেন এতে হৃৎপিন্ড দুর্বল হয়ে যাবে বা রক্তচাপ কমে যাবে, এমনকি কার্যক্ষমতা কমে যাবার আশঙ্কা করেন। ফলে কিছু কুসংস্কার আর অজ্ঞতা অনেক সময় মানুষকে রক্তদানে নিরুৎসাহিত করে।
যে কোন সুস্থ-সবল মানুষ রক্তদান করলে রক্তদাতার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয় না। এমনিতেই আমাদের রক্তের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ৪ মাস পরপর নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এমনি এমনি নষ্ট করার চেয়ে তা স্বেচ্ছায় অন্যের জীবন বাঁচাতে দান করাই উত্তম। সামান্য পরিমাণ রক্তদানের মাধ্যমে একটি জীবন বাঁচানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ।
করোনাকালে দেখা যাচ্ছে- মানুষ হয়েও মানুষ একে অপরের প্রতি অমানবিক, নিষ্ঠুর আচরণ করছে। অথচ আমরা মানুষরাই আবার মানবতার জয়গান গাই-“মানুষ মানুষের জন্যে”। আমাদের সত্যিকারের মানবিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। সর্বোপরি করোনাকালে জাতির এই দুঃসময়ে আমাদের মানবিক হতে হবে।