পাবনার ঈশ্বরদীস্থ বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) চলমান দুই প্রকল্পের একটির তিনখাতেই ২ কোটি ৭৫ লাখ ১৪ হাজার ১২৮ টাকা অডিট আপত্তি জানানো হয়েছে। বিএসআরআই’র ডিজি ও প্রকল্প পরিচালকের পরস্পর যোগসাজছে অনিয়মিত ব্যয় হিসেবে খরচ দেখানো হয়েছে। যা আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ ২০১৫ এর ক্রমিক নম্বর ৩১ এর আদেশ লঙ্ঘন,পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-৮১ (১) (তফসিল-২) এর বিধান লঙ্ঘন ও জিএফআর-রুলস-১২ এর লঙ্ঘন করা হয়েছে।
ঢাকা সেগুনবাগিচাস্থ কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের এএন্ডও ও দলনেতা মোঃ আমিনুর ইসলামের স্বাক্ষরিত গত ২০ নভেম্বর/২০২৩ পত্রের মাধ্যমে অডিট আপত্তির এসব তথ্য জানা গেছে। তবে অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই দুই প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে দুই প্রকল্পে প্রায় ১২ কোটি টাকার মত নতুন করে বরাদ্দ এসেছে। যার মেয়াদ ৩০ জুন/২০২৫ সালে শেষ হবে। বিএসআরআই’এ খোঁঔজ নিয়ে ও বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, বিএসআরআই’এ জুলাই-২০২১ থেকে জুন-২০২৪ সাল মেয়াদে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে “ কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্নবীজ উৎপাদন ও বিস্তার” এবং ১৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে “ আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প” চলমান রয়েছে। আর কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্নবীজ উৎপাদন ও বিস্তার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব্বে রয়েছেন বিএসআরআই’র রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মুখ্য বৈজ্ঞানিক ড.মোঃ শামসুর রহমান। আর আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব রয়েছেন বিএসআরআই’র সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান মুখ্য বৈজ্ঞানিক ড. মোঃ আবু তাহের সোহেল। সুত্রগুলো মতে, গত ২০ ডিসেম্বর-২০২২ সালে বিএসআরআই’এ নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে যোগদান করেন ড. মোঃ ওমর আলী। যোগদানের পর থেকেই ডিজি গবেষণামুলক প্রকল্প দুটির প্রকল্প পরিচালকের নিকট থেকে নানাভাবে অর্থ আদায় করেন। গবেষণা প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা থেকে অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে বিএসআরআই’র প্রধান ফটক, কয়েক মাস ধরে নিজের বাংলো, রেস্টহাউজ সংস্কার-মেরামত ও ফুলের বাগান তৈরী করেন। এতে আনুমানিক প্রায় ৩৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বৈজ্ঞানিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মধ্যে সমালোচনা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা সেগুনবাগিচাস্থ কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের এএন্ডও ও দলনেতা মোঃ আমিনুর ইসলামের স্বাক্ষরিত গত ২০ নভেম্বর/২০২৩ পত্রের মাধ্যমে অডিট আপত্তির ২ নং মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্নবীজ উৎপাদন ও বিস্তার প্রকল্পে প্রশিক্ষণ খাতে আর্থিক ক্ষমতার সীমাতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করায় অনিয়মিত ব্যয় ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৩০ টাকা। প্রকল্পটির প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ ও ব্যয় বিবরণী, প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিল-ভাইচার বাজেট, রেজিষ্টার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্পের ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রশিক্ষণ খাতে প্রকল্প পরিচালকের ব্যয় করার ক্ষমতা রয়েছে ২০ লাখ টাকা। কিন্তু তিনি নিয়ম বর্হিরভুতভাবে প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় করেছেন ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এতে ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৩০ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ ২০১৫ নং ৩১ এর আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে। অডিট মেমো নং-৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে, পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন করে সরাসরি নগদ ক্রয়ে বাৎসরিক সিলিং অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় ২ কোটি ১ লাখ ৯২ হাজার ১২৮ টাকা। প্রকল্পটিতে নগদে ক্রয়কৃত রাসায়নিক, গবেষণা ব্যয় এবং বীজ ও চারার বিল-ভাইচার পযার্লোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালকের নগদে ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনধিক ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারবেন। আর বছরে অনধিক ১০ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক নগদ ক্রয় করেছেন ২ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার ১২৮ টাকা। এতে অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১ লাখ ৯২ হাজার ১২৮ টাকা। এতে পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-৮১ (১) (তফসিল-২) এর বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে।
অডিট মেমো নং-৪ এ উল্লেখ করা হয়েছে,প্রকল্প বহির্ভুত শ্রমিক বিল পরিশোধ করায় অনিয়মিত ব্যয় ৫৭ হাজার ৭২ হাজার টাকা। কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্নবীজ উৎপাদন ও বিস্তার প্রকল্পের অর্থায়নে বিএসআরআই’এর মহাপরিচালক (ড. মোঃ ওমর আলী) ১৮ টি বিভাগ/শাখায় বিধি বর্হিভুতভাবে ৩৭ জন অস্থায়ী দিন হাজিরার শ্রমিককে ৫শ টাকা করে ২৬ দিন হিসেবে ১২ মাসে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। এতে জিএফআর -রুলস-১২ এর লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিএসআরআই’এর সুত্রগুলো মতে, এই অনিয়মিত ব্যয়ের ভুয়া-বিল ভাউচার দিয়েই ডিজি ড.মোঃ ওমর আলী প্রকল্প কর্মকর্তার যোগসাজছে গত এক বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ডিজি একক ক্ষমতা বলে বিএসআরআই’র দুই পরিচালক ও খামার ইনচার্জকে না জানিয়ে রাজস্ব খাতে ২৮জন শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়ে পোষ্যকোটায় নিয়োগ বঞ্চিতরা বাধা দিলে হৈচৈ লেগে যায়। পরে ডিজি স্থানীয় দলীয় কিছু যুবকদের আর্থিকভাবে ম্যানেজ করেন। ওই যুবকদের ডেকে এনে বিএসআরআই’এ বসিয়ে রেখে নিয়োগ দিয়েছেন। একই ভাবে ৩ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাও নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগ দিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন ডিজি। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভিতরে ও বাইরে সমালোচনা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে সুত্রগুলো দাবী করেছে। গবেষণা প্রকল্পের টাকা দিয়ে অবকাঠামো মেরামত সংস্কার করার বিধি সম্মত কিনা জানতে চাইলে “আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প” প্রকল্প পরিচালক বিএসআরআই’র সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান মুখ্য বৈজ্ঞানিক ড. মোঃ আবু তাহের সোহেল বলেন, ডিজি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি। তিনি টাকা চাইলে যেকোনভাবে ম্যানেজ করে তাঁকে টাকা দিতে হয়। আমিও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দিয়েছি। এই টাকা দিয়ে ডিজি ড. মোঃ ওমর আলী ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করেননি দাবী করে প্রকল্প পরিচালক ড. আবু তাহের সোহেল আরও বলেন, আমার জানা মতে ডিজি প্রকল্প থেকে দেওয়া টাকা দিয়ে বিএসআরআই’এর প্রধান ফটক মেরামত সংস্কারসহ অন্যান্য কিছু কাজ করেছেন। অডিট আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে এই প্রকল্প পরিচালক দাবী করে বলেন, অডিট আপত্তি একটি ফরমাল বিষয়। অডিটে আসা কর্মকর্তাদের সুস্বাধু খাবার, থাকার সুব্যবস্থা করা হয়। আবার যাওয়ার সময় চাহিদামত টাকাও দিতে হয়। তারপরও তাদের নিয়ম অনুসারে আপত্তি জানিয়ে যান। এর আগেও প্রকল্পের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সন্তোষজনক হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়েছেন। এতে প্রায় ৩-৪ কোটি টাকা নতুনভাবে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আর আমার এই ছোট্র প্রকল্প নিয়ে আপনাদের এতো উৎসাহ কেন প্রশ্ন করে ড. আবু তাহের সোহেল বলেন, আরও একটি বড় প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। সেখানেও তো অনিয়ম দূর্নীতি রয়েছে। কি ধরণের অনিয়ম, দূর্নীতি রয়েছে জানতে চাইলে সোহেল বলেন, আপনারা সাংবাদিক খুঁজে নিন। কি অনিয়ম ও দূর্নীতি রয়েছে। কৃষক পর্যায়ে আখের রোগমুক্ত পরিচ্ছন্নবীজ উৎপাদন ও বিস্তার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিএসআরআই’র রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মুখ্য বৈজ্ঞানিক ড. মোঃ শামসুর রহমান বলেন, প্রকল্পে নগদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলা প্রতিটি প্রকল্পেই থাকে। তাছাড়া কোন অনিয়ম ও দূর্নীতি করা হয়নি। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে স্ব-স্ব স্থানে গিয়ে নগদে ক্রয় করে কৃষকের হাতে মালামাল পৌছে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের মাসিক বেতন ব্যাংক একাউন্টে দেওয়া হয়। তবে ডিজি ড. মোঃ ওমর আলী কর্তৃক নিয়ম বহির্ভুতভাবে প্রকল্পের টাকা দিয়ে বিভাগ/শাখায় কাজ করা ৩৭ শ্রমিককে বেতন দেওয়ার বিষয়ে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। তার প্রকল্পে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১৫ শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গবেষণা খাতের টাকা দিয়ে ডিজি ড.মো.ওমর আলীর বিভিন্ন অবকাঠামোর কাজ করেছেন। এটা বিধিমোতাবেক হয়েছি কি না জানতে চাইলে ড. শামসুর রহমান বলেন, নিয়মের মধ্যে থেকে আমি শুধু রেস্ট হাউজ সংস্কার-মেরামতে করে দিয়েছি। দুঃখ প্রকাশ করে ড. শামসুর রহমান বলেন, নিয়মের কথা কি বলবো; আমি বিএসআরআই’র সর্ব জ্যেষ্ট বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ডিজি হওয়ার কথা তো আমার। কিন্তু স্ত্রীসহ হজ্ব করে দেশে ফিরে দেখি অন্যজন ডিজি হয়ে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অবসরে যাচ্ছি। তাই কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রান্তিক আখ চাষীরা উপকৃত হওয়ায় প্রকল্পটি আগামী এক বছরের জন্য সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে প্রায় ৮-৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। একই সঙ্গে অডিটের আপত্তির বিষয়ে জবাব দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। এসব বিষয়ে জানতে কয়েকদিন ধরে বিএসআরআই’এর মহাপরিচালক (ডিজি) ড. ওমর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁর কার্যালয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি গেস্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকা ও ঢাকায় থাকার কারণে সরাসরি তাকে পাওয়া যায়নি। এই কারণে তাঁর ব্যবহৃত সরকারী মোবাইল নাম্বারে রিং করা হয়। হোয়াটঅ্যাপে ও মোবাইল নাম্বারে ক্ষুদে বার্তা প্রদান করা হয়। সোমবার সকালে হোয়াটঅ্যাপে সাঁড়া দিয়ে সেখানে সুকৌশলে বিএসআরআই’এ বিজ্ঞানী, শ্রমিক নিয়োগ, প্রকল্প থেকে টাকা গ্রহন, গবেষণা প্রকল্পের টাকা থেকে বিএসআরআই’র প্রধান ফটক, নিজের বাংলো, রেস্ট হাউজ মেরামত-সংস্কার, ফুলের বাগান করাসহ নানা অনিয়মের বিষয়গুলো মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। প্রকল্পের পিডিগন নিজেদের প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন ও খরচ ডিপিপি অনুযায়ী নিজেরাই করে থাকেন। আর অডিট আপত্তি থাকলে তারাই তার সুরাহ করেন।