ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালনের সঙ্গে একটি অনন্য পরীক্ষার ঘটনা বিজড়িত। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে এ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জানমাল ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিবেদিত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কোরবানি করার জন্য আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হন। এটি ছিল হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনের কঠোরতম অগ্নিপরীক্ষা। নতশিরে এ নির্দেশ মেনে নিয়ে প্রিয়তম সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন তিনি। আল্লাহপাক হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানি কবুল করলেন। ইসমাইল জবেহ হলেন না, ইসমাইলের স্থলে দুম্বা জবেহ হলো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এহেন নির্দেশের মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর খোদাপ্রেমের নিষ্ঠা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা ও ইসমাইল (আ.) আল্লাহপ্রেম ও আত্মত্যাগের এ চরম পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গভাবে কামিয়াব হয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সব কিছুই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’ সুরা আনআম : ১৬২)।
সেই আশ্চর্যপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করে প্রতিবছর মুসলিম জাতি ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকে। জিলহজ মাসের দশ তারিখে জামাতে ঈদুল আজহার নামাজ সমাপনের পর সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলমানরা গরু, ছাগল, ভেড়া, উট বা দুম্বা প্রভৃতি পশু কোরবানি করেন। বিত্তশালী মুসলমানরা গরিব-মিসকিনদের সম্পদের অনুপাতে নির্ধারিত পরিমাণ জাকাত দিয়ে থাকেন। ঈদের দিন গরিব, অনাথ-ইয়াতিমদের আপন দুঃখ-অভাব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যায়। এ পবিত্র ঈদ উপলক্ষে মুসলিম জাতি শুধু আনন্দ উপভোগ করে না, দীন-দুঃখীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কোরবানির গোশত, অকাতরে অন্ন ও অর্থ দান করে প্রচুর পুণ্য অর্জন করে। সমাজের অসহায় দুঃখীদের মন সেদিন আনন্দে আহ্লাদিত হতে থাকে।
মানুষের জীবনে সব জিনিসের চেয়ে আল্লাহ এবং তার নির্দেশকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার শিক্ষা রয়েছে এ কোরবানিতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির জন্য জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে হারাতে হলেও তা থেকে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। এ মহান আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে কোরবানির প্রচলন হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা ইত্যাদি খোদাপ্রেম বিরোধী রিপুগুলোকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী বশ ও দমন করার শিক্ষা রয়েছে এ কোরবানিতে। প্রতিবছর ঈদুল আজহা মুসলিম জাহানে এসে মুসলিম জাতির ঈমানী দুর্বলতা, চারিত্রিক কলুষতা দূর করে ত্যাগের উজ্জ্বল ঈমানী শক্তিকে বলিয়ান ও মজবুত করে। মুসলমান জাতি এ কোরবানির মাধ্যমে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দীক্ষা নেয়, সমাজের বুক থেকে অসত্য, অন্যায়, দুর্নীতি ও অশান্তি দূর করার জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা লাভ করে। এ প্রেক্ষিতে কবির ভাষায় বলা হয়েছে, ‘কোরবানি হত্যা নয়, সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন’।
ঈদুল আজহা মুসলমানদের জাতীয় জীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। লোভ-লালসায় জর্জরিত এ মায়াময় পৃথিবীতে ত্যাগের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হতে না পারলে কেউ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে না। কোরবানির মহান স্মৃতি মানুষের মনে ত্যাগের মহান স্পৃহাকে নবরূপে জাগ্রত করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানির শিক্ষা এবং তাৎপর্য ও ত্যাগ মানুষের মন থেকে পশু প্রবৃত্তির বিনাশ সাধন করে এবং বৃহত্তর মানব প্রেমের শিক্ষা দেয়। ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও কোরবানির মাহাত্ম্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন ঈদগাহের কাছে না আসে।’ (ইবনে মাজা : ৩১২৩ )।
ঈদুল আজহার কোরবানির মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্ত-গোশত কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয়, মানুষের হৃদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকারের ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন। পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘কোরবানির জীবের রক্ত-গোশত কোনোটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের খোদাভীতি ও আন্তরিকতা।’ (সুরা হজ : ৩৭)।
সুতরাং কোরবানি করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উচিত কেবল আল্লাহ্ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই ঈদুল আজহায় নিখুঁতভাবে কোরবানি আদায় করতে যতœবান হওয়া। মহামহিমম রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে ঈদুল আজহার আত্মত্যাগ ও কোরবানির মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে মানব এবং সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দান করুন