শিশির ভেজা ভোরে পূর্ব গগনে সূর্যদয় দেখা শুরু বাবার কাঁধে উঠে। সকলের হাওয়া গায়ে লাগানোর উপকারিতা সম্পর্কে বাবা আমাকে রোজ বলতেন। ছোট্ট বেলায় আমি ভোরের আলো উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে পরতাম , বাবার কাঁধে চড়ে সকাল দেখার জন্য । আমার ভোর দেখার ইচ্ছা আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। আমি আজ-কাল ছেলে বেলার স্মৃতি গুলো খুব অনুভব করি। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই বাবা ছোট্ট একটি মুদির দোকান খোলার জন্য বাজারের দিকে রওনা হতেন। আমার সে কি বায়না আমি বাবার কাঁধে উঠে পুরোটা দিন গ্ৰাম দেখবো। সেই সাধের দুরন্ত শৈশব দেখতে দেখতে কেটে গেল। আমার সামনে উপস্থিত আজ সমৃদ্ধশালী কৈশোর। আমার শৈশব পেরোতে না পেরোতেই বাবা জীবিকার তাগিদে গ্ৰাম ছাড়লেন। একই জেলার মধ্যে ধানের খোলায় কাজ নিলেন। আমি তখন খুব কাঁদতাম , ঐ যে ভোর দেখার ইচ্ছার জন্য । ভোর দেখার ইচ্ছা আজও আমার মধ্যে রয়ে গেছে কিন্তু ঐ শৈশব আর নেই। তারপর স্কুল জীবনের শুরু , এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের ছোট্ট পরিবারের দিন যাপন। আমার বড় দিদির সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো বিভিন্ন কারণে , তার কিছুক্ষণ পর আমাদের ঝগড়া বন্ধুত্বে রুপ নিতো। আমি খুব ছোট্ট বেলাতেই দুনিয়া দেখে নিয়েছি অভাবের দুর্বিষহ জীবন যাপনের মাধ্যমে। আমার বাবা আমাদের বুঝতে দিতেন না কিছুই । মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সামান্য কিছু টাকায় সংসার চালতো আমাদের। তবে আমার ইচ্ছা গুলোর মৃত্যু ঘটেনি কখনো । আমার নতুন সাইকেল কেনার সংগ্ৰামের গল্পের স্মৃতিচারণ করলে আমি অঝোরে কাঁন্না করি আজও। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে আজ আমি আকাশ ছুঁয়েছি। স্কুল জীবনের অবসান ঘটিয়ে পদার্পন ঘটবে কয়েক মাসের মধ্যে কলেজ জীবনে । আমার বিজ্ঞান বিভাগের গাইড বই কেনার খরচ এবং প্রাইভেট খরচ জোগাতে আমার বাবার দিন রাত অবিরাম হাড়ভাঙা খাটুনির পরও, আমার হাসির জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন এখনো । যখন সকল কিছুর সমাধানের পথ বের হয় নি তখন আর্থিক কারণেই দুঃখ বাড়তে থাকলো । আমার মা আমাদের চমকে দিয়ে হাতে তুলে নিল আঠা এবং কাগজের বোঝা, মিষ্টির প্যাকেট লেবেলিং করতেন রাত জেগে । সকাল হলেই সেটা বিক্রির টাকা তুলে দিতেন আমাদের ভাই বোনের পড়াশোনার খরচের হিসেবে। আমার জীবনে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন আমার প্রাণপ্রিয় বাবা । যেই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখান থেকে আমরা পড়াশোনার আপোষহীন সংগ্রাম করে পার করছি শিক্ষা জীবন। আজও আমরা দুঃখ চিনি নি , স্বপ্ন বেঁধেছি নিরন্তর বাবার অনুপ্রেরণায়। আমার বাবা আমার জীবনে বাস্তব প্রতিবিম্ব । “যার জন্য বেধেছি মোরা স্বপ্নের ঘর, বাবার মুখে হাসি ফোটানোই মোদের পণ” ।আমার বাবা আমাদের জীবনের প্রকৃত যোদ্ধা । আমি কতদিন বাবার সাথে কাজে যেতে চেয়েছি । প্রতিউত্তরে বাবা বরাবর স্মারকলিপি দিয়ে বলেছেন বড় হও প্রার্থনা করি , মানুষ হও । বাবা আমার কাছে দেবতা । দুবেলা দুমুঠো ভাত না খেয়ে থেকেছি বহুদিন , কেউ জানবে না আমাদের টিকে থাকার উপন্যাস। যার কাঁধে চড়ে স্বপ্ন বোনা শিখলাম তাকে কেমন করে ভুলে যাই । আমি যদি বাবার আশীর্বাদে সফলতার দেখা পাই , বাবার জন্য স্মৃতির পাতায় লিখতে চাই আজীবন । তার ঘাম ঝড়া আর্তনাদ , আমাদের পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখতে শুরু করবে নিশ্চিত। আমি আজ নিজেকে নিয়ে আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদি । আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আমার বাবা বেঁচে থাকার সংগ্রাম যেন কোনো বাবাকে না করতে হয় কোন দিন। আজ বাবা দিবসে শ্রদ্ধা জানাই , বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই স্মরণ করি এমন হার না মানা বাবাদের গল্পে।