মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন:
জিলহজ মাস মানে হজের মাস। হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ – এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কুরআন কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো, আল্লাহ্ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে, আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, তোমরা আমাকে ভয় করো [সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৭]।
পুরো জিলহজ মাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ মাসের প্রথম ১০ দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। কুরআনে কারীমের সূরা ফজরের শুরুতে আল্লাহ্ তায়ালা এই ১০ রাতের কসম খেয়ে বলেন, কসম ফজরের এবং ১০ রাতের। এর দ্বারা জিলহজের প্রথম দশকের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। এখানে যে ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা হলো জিলহজের প্রথম ১০ রাত। [তাফসিরে ইবনে কাসির, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৫]
হাদিস শরীফে আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ্ তায়ালার নিকট কোনো দিনের আমলই এই দিনগুলোর নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর নয়। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ্ তায়ালার রাস্তায় জিহাদও নয়?
উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, না আল্লাহ্ তায়ালার রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের জান ও মাল নিয়ে আল্লাহ্ তায়ালার রাস্তায় জিহাদে যায় এবং সে কোনো কিছু নিয়ে ফিরে না আসে।’ [সহীহ বুখারী : ১/১৩২, আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৮]
এই ১০ দিনের মধ্যে শেষের দু’দিন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাকে হাদিসের পরিভাষায় ‘ইয়াওমে আরাফা’ ও ‘ইয়াওমে নাহর’ বলা হয়। এ ছাড়াও দু’টি ইবাদত এ মাসের প্রথম দশককে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে। যে ’দুটি ইবাদত জিলহজ মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে আদায় করা সম্ভব নয়। এমনকি রমজানেও নয়। একটি হলো হজ, অপরটি কুরবানী। তাই নিশ্চিতভাবেই হজ ও কুরবানী এ দু’টি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। এ ছাড়াও হজের সাথে রয়েছে ওমরাহ’র মতো ফজিলতপূর্ণ আমলের সুযোগ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ আর কবুল হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ [বুখারী, হাদিস : ১৭৭৩, মুসলিম, হাদিস : ৩৩৫৫]
এ মাসের করণীয় আমল- প্রথমত, যাঁদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে তাঁদের জন্য উচিত বিলম্ব না করে হজ আদায় করা। আমাদের সমাজে অনেক বিত্তবান আছেন, যাঁদের ওপর হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা নানা উসীলায় তা আদায়ে বিলম্ব করে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তারপর হজ করবেন, কেউ মনে করেন চাকরী থেকে অবসরের পর হজ করে আল্লাহর কাজে সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করবেন, আবার এমনও দেখা যায় কেউ কেউ মনে করেন হজ করে এলে ঘুষ-দুর্নীতি করা যাবে না কাজেই অবসরের পরেই হজ করবেন। অথচ এ শ্রেণীর মানুষ ভুলে যান যে ঘুষ-দুর্নীতি সকল সময়ের জন্যই হারাম। মুসলমান হিসেবে কোনো পুণ্যময় কাজে কখনোই অবহেলা কিংবা বিলম্ব করা উচিত নয়। বিশেষ করে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলের ক্ষেত্রে সকলেরই যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ হজের জন্য নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হওয়া মাত্র তার ওপর হজ ফরয হয়ে যায়। কিন্তু ঐ সম্পদ যে চিরদিন হাতে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্পদ যদি হাত ছাড়া হয়েও যায় তাহলেও কিন্তু ফরয হজের দায় মুক্ত হওয়া যাবে না। তাই সকলেরই উচিত নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হওয়ার সাথে সাথে হজ আদায় করে নেয়া।
দ্বিতীয়ত, কুরবানী আদায় করা। যাঁদের ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব, তাঁরা তো অবশ্যই কুরবানী আদায় করবেন। এমনকি যাঁদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাঁদেরও কুরবানী করার চেষ্টা করা উচিত। আগ্রহ ও ইচ্ছা থাকলে নিঃস্ব ব্যক্তিকেও আল্লাহ তায়ালা সামর্থ্যবান করে দিতে পারেন। বাহ্যিক সামর্থ্য ও আর্থিক সচ্ছলতা তো আল্লাহ তায়ালার হাতে। সে কারণেই কুরবানী ওয়াজিব না হলেও কুরবানী করার চেষ্টা করা উচিত।
তৃতীয়ত, জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগে পর্যন্ত নখ, চুল, গোঁফ ও অবাঞ্ছিত পশম ইত্যাদি না কাটা। হাদিসে আছে, হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা যখন জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেনো চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। [সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৩৬৫৬, ইবনে হিব্বান] এ ছাড়াও কুরআন, হাদিস নির্দেশিত সকল প্রকার হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
চতুর্থত, এই মাসের প্রথম দশক যেহেতু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল এবং এ সময়ের আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রিয় ও গ্রহণীয় – তাই এই দশকে বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। বিশেষত নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, দান-খয়রাত ইত্যাদি।
জিলহজের প্রথম দশকে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) জিলহজের প্রথম ৯ দিন (ঈদের দিন ছাড়া) রোজা রাখতেন। তবে এই দশকের নবম দিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দিন রোজা রাখার গুরুত্বও অনেক বেশি। হাদিসে আছে, রাসূল (সা.) বলেন, আরাফার দিনের (৯ তারিখের) রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। [তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৭] অন্য একটি হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের নফল রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো’ [তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৮]।
পঞ্চমত, ৯ জিলহজের ফজর থেকে ১৩ জিলহজের আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক বলা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব। তাকবিরে তাশরিক হলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।’ [ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮, বায়হাবি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৪৭৪]।
নামাজ একাকী কিংবা জামাতের সঙ্গে, পুরুষ-মহিলা প্রত্যেকের ওপর একবার এ তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষ উচ্চস্বরে আর নারী অনুচ্চস্বরে তাকবির বলবে। [ফাতাওয়ায়ে শামি]
একটা নফল রোযা রাখাই কষ্টকর তার ওপর এক বছর নফল রোযা! অথচ জিলহজ মাসের প্রথম দশকে প্রতিদিনের জন্য এক বছর নফল রোযার সওয়াব পাওয়া যাবে। পাশাপাশি রাতের আমলের ব্যাপারে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাত লাইলাতুল কদরের সমান ফজিলতপূর্ণ। আমরা জানি, রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলেছেন। যদি কোনো ব্যক্তি রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই কদর তালাশের নিয়তে ইবাদত করতে থাকেন তাহলে আশা করা যায়, তিনি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাবেন।
কিন্তু যদি বেশির ভাগ প্রচলিত আমলের মতো ২৭ রমজানের রাতে তালাশের নিয়তে ইবাদত করা হয় তাহলে লাইলাতুল কদর পেয়ে গেলাম – এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। অথচ কেউ যদি জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রতি রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেন তাহলে নিশ্চিতভাবে তিনি দশটি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাবেন। এ যুক্তির দ্বারা রমজানে কদরের ফজিলতকে কোনো ভাবেই ছোট করা নয় বরং জিলহজের ইবাদতের গুরুত্ব বুঝানোই উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে বুঝে-শুনে সহীহভাবে সকল আমলের পাশাপাশি এ ধরণের বোনাস আমলগুলো বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন।