সাইদুজ্জামান সাগর:-
ফার্সি একটা প্রবাদ আছে, ” দের আয়েদ দুরুস্ত আয়েদ” ( যা দেরিতে আসে তা সাজানো গোছানো হয়েই আসে) করোনা ভাইরাসও যেন সাজানো গোছানো হয়েই এসেছে! নামেই তা বুঝা যায়। ভাইরাসের নামটি যদি ভেঙ্গে বলি তাহলে সাজানো গোছানোর একটি স্বাদ পাওয়া যাবে যেমন:- করোনার (corona) co, ভাইরাসের (virus) vi, রোগের(Disease) d,এবং ২০১৯ এর 19, মিলে হয়েছে covid19। যার ৭ রকম প্রকরণে পুরো দুনিয়া কাঁপছে! প্রতিরোধে নেয়া হয়েছে নানা বিধিব্যবস্থা। ভাইরাসটি ষাটের দশকে দেখা দিলেও ২০১৯ সালের শেষের দিকে পৃথিবী জুড়ে বিস্তার লাভের সিরিয়াল পেয়ে কোমর বেঁধে যেন মাঠে নেমেছে কোভিড নাইন্টিন!
প্রায় ৮ মাসের ব্যবধানে সারা পৃথিবীতে ১, ১৯, ৪৯, ২৮০ জন মানুষ নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৫, ৪৬, ৬০১ জনের ! (তথ্য দৈনিক সংবাদ ০৮-৭-২০ খ্রি) এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি নেই, নেই কোনো ভ্যাকসিন। এই ভাইরাসের কবলে পড়ে অনিশ্চিত একটা শঙ্কা নিয়ে পৃথিবীর মানুষ কাঁদছে!
করোনা কবলিত পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা: চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল গ্রামের একটি পুকুর পাড়ে বসে আছি, রাত তখন সাড়ে আটটা। ফোন আসলো এক সাংবাদিকের, ভাই নওগাঁতে প্রথম করোনা পজেটিভ একজন নার্স! তিনি আপনার এলাকার মেয়ে! আধাঘন্টার মধ্যে দেখলাম বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে খবরটা প্রকাশিত হলো। খবর প্রকাশিত হওয়ায় এলাকায় অনেক সমালোচনা শুরু হলো! কেউ বলছে নিউজ করা ঠিক হয়নি, এটা ওই নার্সের মানহানির সামিল!? কেন তার নাম, গ্রাম ও কর্মস্থলের পরিচয় প্রকাশ করা হলো? আবার কেউ বলছে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিউজটা প্রয়োজন ছিল ইত্যাদি।
২৪ এপ্রিল নতুন আরো একটি তথ্য পেলাম, নারায়নগঞ্জ ফেরত নওগাঁর রাণীনগর উপজলার বিলপালশা গ্রামের কামরুজ্জামান নামের একজন করোনা শনাক্ত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য তার ঠিকানা ছিল ভুল! পরে জানা গেলো শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করায় এ ভুলটা হয়। কামরুজ্জামানের বাড়ি আর ওই নার্সের বাড়ি একই গ্রামে, মানে উপজেলা সদরের খাগড়া গ্রামে! করোনা আক্রন্ত কামরুজ্জামান শ্বশুর বাড়ি থাকছেন, তাই শ্বশুর বাড়ির সবার নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে তার গর্ভবতী স্ত্রীর বাচ্চা হয়েছে নওগাঁ জেলা শহরের একটি হাসপাতালে। শুধুমাত্র একজন বাবা হিসাবে তিনি চলে গেলেন সন্তানকে দেখতে! বিষয়টি জানাজানি হলে শহরের মধ্যে পুলিশ অনেক খোঁজাখুজি করে তাকে আটক করে স্বাস্থ্য বিভাগে সোপর্দ করে। একজন বাবার দ্বয়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে তার হয়তো জানা নেই, জানলে হয়তো স্ত্রী সন্তানদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিত না। পরে জানা যায়, তার ৬ দিনের সন্তান, স্ত্রী, শ্বশুর, শ্বাশুরি এবং দুই জন শ্যালক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
কামরুজ্জামানের করোনা পজিটিভ খবর এলাকায় যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তার পরিবার স্থানীয় এক প্রকার রাজনীতির খপ্পরে পড়ে! গ্রামের ভিতর কথা চলে যে, কামরুজ্জামান নারায়নগঞ্জ থেকে প্রথমে নিজ বাড়িতে ভোর রাতে আসে তারপর সে সকালে শ্বশুর বাড়ি যায়! কথাটা রাণীনগর থানা পর্যন্ত গড়ায়, পুলিশ হাজির হলো তাদের দ্বায়িত্ব পালন করতে, লাল ফ্লাগ দিয়ে ঘোষনা দিলো আপনাদের বাড়ি আজ থেকে লকডাউন! তখন পুরোদমে এলাকায় চলছে ইরি-বোরো ধান কাটামাড়াই। কামরুজ্জামানের বাবা ফরিদুল এবং ছোট ভাই মোর্শেদ মিলে পৈতিক ও বর্গা মিলে মোট ৭ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছে।ভরা মৌসুমে পাকা ধান নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে তারা, আড়ালে থাকা শক্তির জোরে কাটতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের ধান! ইস্যু হলো করোনা আক্রান্ত পরিবার! কিন্তু ঘটনার গভীরে রয়েছিল রহস্যময় ধাঁন্দা! হঠাৎ করে একদিন বিকেলে নওগাঁ -৬ (রাণীনগর-আত্রাই) আসনের সংসদ সদস্য ফোন করে বললো “সাগর তোমার পাশের গ্রামে লকডাউন পরিবারের ধান কাটতে দিচ্ছে না! কারা এরা? তুমি যেহেতু এলাকায় আছো বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের পদক্ষেপ নাও। আমি বললাম ঠিক আছে সরেজমিন গিয়ে দেখছি। ওই গ্রামে গিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য, ক্ষমতাশীন দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা সহ গ্রামের বেশ কয়েক জন গণ্যমাণ্য বক্তিকে ডেকে নিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করা হলো।
তখন এলাকায় প্রশ্ন উঠে, নমুনা সংগ্রহ ছাড়াই সুস্থ্য সবল মানুষ গুলোকে ঘরে আটক রাখার নামই কি লকডাউন? ধান কাটার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় আমার প্রতি তাদের মধ্যে একটা ভরসা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ভরসার ভিত্তিতে তারা ঘরের জানালা দিয়ে লোক ডেকে তাদের মাধ্যমে খবর পাঠালো যে, ১৪ দিন হয়ে গেছে, আমরা সুস্থ্য আছি, আমাদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন! ওই লোকদের কাছ থেকে আমার ফোন নাম্বার নিয়ে আমার কাছে কামরুজ্জামানের ছোট ভাই ঘরবন্দি মোর্শেদ ফোন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমি বললাম বিষয়টি দেখছি কি করা যায় চিন্তা করেন না। প্রথমে রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ কে বললাম, তিনি বললেন এটা স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যাপার! লকডাউন তো আপনারাই দিয়েছেন? আপনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে কথা বললাম, তিনি বললেন সাগর ভাই আপনি গিয়ে লাল ফ্লাগ তুলে দেন তাহলেই হবে, আমি বললাম অসম্ভব পুলিশের দেওয়া ফ্লাগ আমি তুলতে পারি না, তিনি বললেন আমাদের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা নেয়।
আর একবার ওসি সাহেবের সাথে কথা বলেন, আবার ওসি’র সাথে কথা বললাম ওসি ওই একই কথা বললেন আপনি গিয়ে তুলে দেন, তবে ইউএনও স্যারকে একবার বললে ভালো হতো! আমি তাই করলাম ইউএনও সাহেবের সাথে কথা বললাম, তিনি সব শুনলেন কিন্তু কোন সমাধান দিলেন না! ১৭ তম দিনে ওসি সাহেব আমাকে বললেন আপনি একটু কষ্ট করে ওখানে গিয়ে লকডাউন মুক্ত করুন, থানার পুলিশরা বর্তমানে ভীষন ব্যস্ত, কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিয়েন। প্রিয় এক বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, আবার স্থানীয় ইউপি সদস্য সহ গ্রামের লোকজন কে ডেকে বিষয়টি বললাম এবং প্রয়োজনে ওসি সাহেবকে ফোন করার কথা বললাম। সব ঠিকঠাক এর মধ্যে ক্ষমতাশীন দলের বড় নেতার এক ভাগিনা আমাকে ফোন করে বলে পুলিশ লকডাউন দিয়েছে পুলিশ না আসা পর্যন্ত লকডাউন তোলা যাবে না! আপনি আসছেন, ঠিক আছে, এখন প্লিজ চলে যান! চলে আসলাম! নিরুপায় হয়ে রাণীনগর প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে বিষয়টি বললাম, সাধারণ সম্পাদক ইউএনও’র সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ১৮তম দিন দুপুরে ইউএনও নিজে এসে লকডাউন তুলে দেন। এই পুরো ঘটনা কি স্থানীয় রাজনীতি? নাকি মহামারির অমানবিকতা? কিংবা সুযোগের নিষ্ঠুরতা? তা আমার জানা নেয়!
করোনা ভাইরাসের দাপটে চলমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলতে পারছে না যে এটির ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে কিনা! এ পরিস্থিতিতে করোনার সঙ্গেই আমাদের সহাবস্থান করতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেয়। তাই ভাইরাস ঠ্যাকাতে অতিসত্বর আমাদের স্ব-স্ব এলাকাকে করোনা সহিঞ্চু এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
করোনা সহিঞ্চু এলাকা গড়ে তুলতে হলে প্রথমে আমাদের জীবন-যাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। সেক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় কঠোর ভাবে পালন করতে হবে আমাদের যেমন:- পরস্পর স্পর্শ থেকে বিরত থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, অপ্রয়োজনে বাহিরে ঘোরাঘুড়ি না করা, শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, সব সময় হাত পরিস্কার রাখা জরুরি।
আমাদের আচরণ ও অভ্যাস পরির্তন করতে এলাকা ভিত্তিক মুরব্বি ও তরুন-তরুনীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যে কমিটি করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখবে যেমন:- মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার নিশ্চিত করা, জনসমাগম হতে না দেয়া, সহনশীল হওয়ার পরামর্শ সহ যেখানে সেখানে কাশি বা থুথু না ফেলতে উদ্ধুদ্ধ করবে। করোনা শনাক্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য্যশীল হতে উদ্ধুদ্ধ করা এবং যথাসাধ্য সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করা, এছাড়াও এলাকার অসহায় পরিবারদের সহযোগিতা মূলক সব বিষয় গুলো নিশ্চিত করা।
আমাদের বহুদিনের কিছু খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে, ভাজা-পোরা, বাসি-পঁচা অপুষ্টিকর খাবার অবশ্যই পরিহার করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে মৌসুমি ফল পরিমাণ মত খাওয়া প্রয়োজন।
প্রতিটি গ্রামে বা মহল্লায় চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট একটি রাস্তা খোলা রাখা। এতে সকলের মধ্যে সতর্কতা সৃষ্টি হবে। এবং বহিরাগতদের ব্যাপারে সজাগ থাকা সম্ভব হবে। নির্দিষ্ট একটি রাস্তা খুলে রেখে সবগুলো রাস্তা হঠাৎ বন্ধ হলে সকল শ্রেণীর মানুষরাই কিছু দিন হয়তো একটু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তারপর ঠিকই অভ্যাস হয়ে যাবে।
পরিশেষে একটি কথা সেটা হলো: নিজের সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে তাহলেই করোনা সহিঞ্চু এলাকা গড়ে তোলা এবং এর সঙ্গে সহাবস্থান করা সম্ভব হবে।