রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩২ অপরাহ্ন

ই-পেপার

ধাতুগত চিকিৎসায় প্রেসক্রিপশনের ভিত্তি – ডা. জহুরুল ইসলাম

ডা.এম.এ.মান্নান, স্টাফ রিপোর্টারঃ
আপডেট সময়: সোমবার, ৪ জুলাই, ২০২২, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ণ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ধাতুগত ক্ষেত্রে (Constitutional sphere) চিকিৎসার ব্যাপারে প্রেসক্রিপশনের ভিত্তি সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই। একটা প্রশ্ন প্রায়শ মনকে পীড়িত করে – আমরা নিজেদেরকে হোমিওপ্যাথ বলে আদৌ দাবী করতে পারি কিনা! আমার বিশ্বাস, হোমিওপ্যাথিক বাক্স থেকে হোমিও শিশি বের করে ওষুধ দিলেই তা যেমন হোমিওপ্যাথি হয় না, তেমনি যিনি ওষুধ দেন, তাঁকেও গণ্য করা যায় না হোমিওপ্যাথ হিসেবে, যদি না তিনি হোমিওপ্যাথিক নীতিমালার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে আন্তরিক হন। চিকিৎসককে প্রথমে হতে হবে হোমিওপ্যাথ, তারপর আসে কনস্টিটিউশনের কথা। কারণ হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে কনস্টিটিউশনের বালাই নেই। কাজেই সেসব ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনের ভিত্তি তথাকথিত প্যাথলজি বা রোগতত্ত্ব। দুঃখের বিষয় হোমিওপ্যাথির পবিত্রাঙ্গনে এমনি একটি প্রবণতা ক্রমশ প্রসার লাভ করছে।
অর্গানন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে চিকিৎসক কি করে হতে হয়, কিই বা চিকিৎসকের লক্ষ্য, এবং সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কিভাবে কোন্ পন্থায় চিকিৎসা কর্মটি পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে অধিকাংশ চিকিৎসকের কর্মকান্ডে মনে প্রশ্ন জাগে—চিকিৎসা-বর্ণবোধ বলতে কোনো বস্তুর সাথে এঁদের পরিচয় আছে কিনা!
এমন অনেক চিকিৎসককে দেখা যায়, যাঁদের সামনে থাকে রোগীদের সুদীর্ঘ লাইন। তাঁরা একজন রোগীকে পাঁচ মিনিটের বেশী সময় দিতে পারেন না। দু’কথা শুনেই ঘ্যাঁচ করে প্রেসক্রিপশন দিয়ে দেন। কেউ কেউ নাকি শুধুমাত্র পায়ের নখ দেখেই প্রেসক্রিপশন করেন, অন্য কিছুই দেখার বা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না। (তবে কি হোমিওপ্যাথি আধিভৌতিক বা আধ্যাত্মিক জাতীয় কোন কিছু?) অনেকে সহজ সরল চুটকি রিপার্টরির সাহায্যে প্রায় অন্ধভাবে প্রেসক্রিপশন হাঁকান। এ ধরণের রকমারি কারবার যে কতোজনে কতোরূপে চালাচ্ছেন, তার সীমা-সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। প্রেসক্রিপশন করার ক্ষেত্রে এদের ভিত্তি কি অভিজ্ঞতা, নাকি অজ্ঞতা?
একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের জানা দরকার চিকিৎসকের ব্রত কি? অর্গাননের প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের সাথে একাত্ম হয়ে তৃতীয় সূত্রের মর্মবানী অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই যুক্তিবাদী চিকিৎসক হিসেবে সংস্কারমুক্ত মনের অধিকারী হওয়া যেতে পারে।
বিষয়টি স্বল্প কথায় যে ভাবে বলে গেলাম, সম্পাদনের বেলায় কিন্তু এতো সহজে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ এ একটা বিশাল সমুদ্র। সমুদ্র পাড়ি দিতে যেমন আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পুর্ণ ও স্বয়ংক্রিয় জাহাজের প্রয়োজন, চিকিৎসা-সমুদ্র পাড়ি দিতেও তেমনি চিকিৎসককে হতে হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাহাজ। জাহাজ তৈরীতে যেমন নির্ধারিত ফর্মের স্টিল সহ নির্ধারিত প্রচুর উপাদান প্রয়োজন হয়, ঠিক অনুরূপভাবে একজন চিকিৎসক তৈরীতেও লাগে নির্ধারিত উপাদান সমূহ। আর এসব উপাদানের আধার হল ‘অর্গানন’ ও ক্রনিক ডিজিজেস’ গ্রন্থদ্বয়। বিশেষ করে অর্গানন আমাদের ধ্রুবতারা, যা আঁধারে পথ দেখায়, দিকনির্দেশ করে। তবে চিকিৎসকের ও চক্ষুষ্মান হতে হবে। কারণ অন্ধ কোনোদিন ধ্রুবতারা দেখতে পায় না। আবার চোখ থাকলেই কিন্তু ধ্রুবতারা দেখা যায় না। চোখ দুটোকে ধ্রুবতারা দেখার মতো উপযুক্ত করে তুলতে হয়। কি করে?
ভূমিকার পরে এবার দ্বিতীয় পর্যায়। রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। রোগ কাকে বলে, রোগের আকৃতি, প্রকৃতি, শ্রেণি, প্রবণতা, পরিণতি ইত্যাদি।
জানতে হবে মায়াজমতত্ব। কারণ মায়াজম (Miasm) বা রোগ বিষ-শক্তি সকল নষ্টের মূল। এরপর আসে ওষুধের কথা। রোগ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ওষুধ সম্পর্কেও জ্ঞানার্জন করতে হবে। প্রতিটি ওষুধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যদি জানা থাকে, যদি জানা থাকে ওষুধ প্রয়োগের রীতিনীতি, কার্য্যকারিতা ও ক্রিয়ার সময়সীমা এবং আরোগ্য-পথের সম্ভাব্য বাধা অপসারণের কলা-কৌশল, তাহলে, হ্যানিম্যান বলেন,
“Then he understands how to treat judiciously and rationally, and he is a true practitioner of the healing art.”
রোগ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে রোগটা ধাতুগত কিনা জানতে অসুবিধা হয়না। এবং সেটা জানার পরই প্রশ্ন ওঠে ওষুধের। কিন্তু আমি তো রোগ চিকিৎসা করি না। Homoeopathy treats the patient- তা’হলে? রোগ নয়, রোগী—এ কথার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। রোগীরা চিকিৎসকের নিকট কিছু কষ্ট নিয়ে হাজির হয়। আলসার, ক্যানসার, যক্ষ্মা ইত্যাদি। কিন্তু চিকিৎসককে কি চিকিৎসা করতে হবে? আলসার? ক্যান্সার? যক্ষ্মা? অথবা অন্য কিছু?
পূর্বোল্লিখিত তথাকথিত হোমিওপ্যাথ নামধারী কিছু চিকিৎসক নামবাচক রোগ চিকিৎসা করে থাকেন, তাঁরা কখনও একটা ওষুধ, কখনো একাধিক ওষুধ একসাথে, কখনো বা পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা দেন। কিন্তু সত্যিকারের একজন হোমিওপ্যাথের কর্তব্য – রোগী যে কষ্ট নিয়েই আসুক, প্রথমে তার যাবতীয় কষ্টের কারণ, আকৃতি, প্রকৃতি, হ্রাস, বৃদ্ধি ইত্যাকার খুঁটিনাটি সকল বিবরণসহ সার্বদৈহিক ও মানসিক লক্ষণাদি লিপিবদ্ধ করতে হবে। অর্গাননের ৮৩ থেকে ১০৩ পর্যন্ত সূত্রে বর্ণিত নীতির ভিত্তিতে রোগীলিপি তৈরি করা হলে বুঝতে হবে – “the most difficult part of the task is accomplished.” (১০৪ সূত্র)। কারণ Totality of symptoms বা লক্ষণসমষ্টিই প্রেসক্রিপশনের ভিত্তি। এই পর্যায়ে রোগ ও রোগ নিরাময় সম্পর্কে কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়।
হোমিপ্যাথিতে রোগসমূহকে মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। Acute বা অচির রোগ ও Chronic বা চিররোগ। এদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সাধারণত অনুসৃত হয় দু-রকম পদ্ধতি। অচিররোগে চিকিৎসককে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কারণ এর প্রকৃতি চিকিৎসককে সময় না দেবার প্রবণতা। কিন্তু চিররোগ যেমন দীর্ঘস্থায়ী তেমনি জটিলতায় সমৃদ্ধ। যদিও কোন কারণঘটিত ব্যাপারে সুপ্ত মায়াজমের সাময়িক উচ্ছ্বাসে অচির রোগের প্রকাশ, তবুও চিকিৎসার ক্ষেত্রে মামুলি নিয়মে স্বল্পক্রিয় ওষুধই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে চিররোগে ধাতুগত চিকিৎসার পদ্ধতি অনুসরণীয়। অবশ্য অনেক সময় অচিররোগেও ধীরে ধীরে এদিকে মোড় নেয়। তখন চিকিৎসককে তাকাতে হয় কনস্টিটিউশনের দিকে।
লক্ষণ সংগ্রহের ব্যপারে আসা যাক। অর্গাননের ৮৩ থেকে ১০৩ পর্যন্ত সূত্রের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তারই ভিত্তিতে লক্ষ্মণ সংগ্রহ করতে হবে। যেমন—
(ক) Common diagnostic and uncommon individualistic symptoms অর্থাৎ PUSS—Peculiar, Uncommon, Striking ও Singular;
খ) Pathological symptoms অর্থাৎ morbid condition, location, sensation, modalities, physical changes, mental changes, subjective symptoms, objective symptoms;
গ) Intellectual aspects;
ঘ) Social aspects;
ঙ) Environmental aspect;
চ) Miasmatic Sphere;
ছ) Constitutional aspects;
জ ) Past history of the patient;
ঝ ) Family history;
ঞ) Causation;
ট ) Iatrogenic sphere;
ঠ ) Generalities ইত্যাদি;
এর প্রত্যেকটা গুরুত্ব সহকারে বিচার করতে হবে। অতপর কোনটার উপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তা নির্ভর করে চিকিৎসকের ওপর, চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার ওপর।
কাজেই Be rational, Be judicious- বিচক্ষণ ও যুক্তিবাদী হতে হবে। মনকে করতে হবে সংস্কারমুক্ত। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবকিছু ঠিকঠাক হওয়া সত্ত্বেও অর্থাৎ যথারীতি রোগীলিপি তৈরি করার পরেও অযৌক্তিক ভাবে হয়ত সঠিক ওষুধটি নির্বাচিত হতে পারে না। বিচক্ষণতা, যুক্তিবাদিতা ও সংস্কারমুক্ত মনের অভাবেই এ ঘটনা ঘটে থাকে।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৮২ সালের কথা। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর রোগের চিকিৎসায় ছয়জন বিশিষ্ট চিকিৎসক একত্রিত হয়ে রোগীলিপি তৈরি করা হয়। এবং রোগীলিপি অনুসারে লক্ষ্মণসমষ্টির ভিত্তিতে পাঁচজন চিকিৎসক দুটি করে ওষুধের নাম বলেন। তাঁদের মধ্যে থুজা ছিল কমন। একজনের ওষুধ ছিল হাইপেরিকাম ও থুজা। ছয়জনের মধ্যে অবশিষ্ট জন খুব প্রভাবশালী ও নামীদামী ডাক্তার। তিনি একটি মাত্র ওষুধের নাম বলেন। আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম।
যুক্তিতে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “রোগী একাই যে মিষ্টি খেতে পারেন আমরা ছয়জনেও তা পারবো না”। এবং এটা নাকি তার চাক্ষুস দেখা। অথচ রোগীলিপি অনুসারে রোগী মিষ্টি পছন্দ করেন, কিন্তু খেলে কোন অসুবিধেও হয় না। তাছাড়া গ্রীষ্মের সেই তাপদগ্ধ দিনেও রোগী দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকেন। কাপড়ও গায়ে দেন। অত্যন্ত গোপনতা প্রিয়। তবুও তাঁরই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সকলে বাধ্য হয়েছিলেন। আর্জেন্টাম নাইট্রিকামই দিতে হয়েছিল। ফল শুধু নিষ্ফল নয়, রোগীর প্রাণসংশয়ও দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত থুজাই তাঁকে সঙ্কটমুক্ত করলেও পরমমুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়।
অতঃপর রোগীর অনুরোধে আরেকবার রোগীলিপিখানা পর্যালোচনা করে হাইপেরিকামের প্রেস্ক্রাইবারের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে হাইপেরিকাম অপরিহার্য। কারণ রোগীর ছোটবেলায় দু-দুবার গাছ থেকে পড়ে কোমরে ভীষণ আঘাত পান। এখনো মাঝে মাঝে ব্যথা অনুভব করেন। এ ঘটনাকে তিনি গুরুত্ব দিলেও প্রথমবার অন্য কেউই গুরুত্ব দেননি। যাই হোক, হাইপেরিকাম এক মাসের মধ্যে রোগীকে অফিসে পাঠাতে সক্ষম হয়। পড়ে অবশ্য থুজা দু’ কোর্স দিতে হয়েছিল।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো – রোগী থুজার হলেও জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা থুজার গতিপথে বাঁধার বিন্ধ্যাচল সৃষ্টি করে রেখেছিল। এবং সেই বাঁধা অপসারিত হবার পরেই থুজা তার স্বাভাবিক ক্রিয়ায় সার্থক হতে সমর্থ হয়। সুতরাং Unprejudiced observer না হলে, কি Judicious কি Rational, কোন কিছুই হওয়া যায় না। শুধু ব্যর্থতার গ্লানিই হয় পাথেয়। কাজেই “If the physician clearly perceives what is to be cured in disease” বাক্যাংশটির মর্মাথ অনুধাবনের ব্যাপারে ওপরের ঘটনাটিই যথেষ্ট। এভাবেই কিছু ঘটনা অঘটন ঘটায় এবং এভাবেই আসতে পারে তার প্রতিকার।
শেষ কথা, লক্ষ্মণসমষ্টিই হোমিওপ্যাথিতে রোগ। এবং সে রোগ নির্মূল করতে হলে প্রেসক্রিপশনের ভিত্তি হবে ঐ লক্ষ্মণসমষ্টি বা Totality of symptoms। এবার আপনি প্রেসক্রিপশন করতে পারেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর