চলনবিলের আলো অনলাইন:
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্বে এখন রমজান মাস। এমন অসংখ্য মুসলিম আছেন, যাঁরা তাকবির উলাসহ মসজিদে নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত; তাঁদের জীবনে কখনো জামাত ছাড়ার রেকর্ড নেই। এসব ‘মসজিদ অন্তপ্রাণ’ মুমিন কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর আরশের ছায়া লাভে ধন্য হবেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের ভয়াল ছোবল থেকে আত্মরক্ষার অবলম্বন সামাজিক দূরত্ব। তাই জনবহুল স্থান পরিহারের অংশ হিসেবে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় সাময়িকভাবে সীমিত করা হয়েছে। এই সুযোগে পবিত্র রমজানের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘তারাবি’কে গুরুত্বহীন বলা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, হতাশাব্যঞ্জক—যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। করোনাভাইরাসের কারণে মসজিদে যেতে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে ঠিক, তবে তার অর্থ এই নয় যে তারাবির নামাজ গুরুত্বহীন। বরং এটি একটি জরুরি অবস্থা। আর জরুরি অবস্থায় ইসলামী শরিয়তে অনেক বিষয়ে ছাড় রয়েছে। তাই ঘরোয়া পরিবেশে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে একাকী বা জামাতে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত তারাবির নামাজ আদায় করতে হবে।
আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশে তারাবি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত হিসেবে আদায় হচ্ছে। তারাবি বাঙালি মুসলিম সমাজের অন্যতম ধর্মীয় সংস্কৃতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তারাবি নামাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনের নিবেদন—
‘তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,
মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।
চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,
ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।
তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লণ্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।’ (তারাবি, মাটির কান্না কাব্যগ্রন্থ)
কবি শুধু তারাবির নামাজে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেননি; বরং তারাবির জামাত বন্ধ হওয়ায় আক্ষেপও করেছেন। লিখেছেন—
‘মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর,
বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার।
ছেলেরা তাহার সুদূর শহরে বড় বড় কাজ করে,
বড় বড় কাজে বড় বড় নাম খেতাবে পকেট ভরে।
সুদূর গাঁয়ের কি বা ধারে ধার, তারাবি জামাতে হায়,
মোমের বাতিটি জ্বলিত, তাহা যে নিবেছে অবহেলায়।’ (তারাবি, মাটির কান্না কাব্যগ্রন্থ) ‘তারাবি’ অর্থ বিশ্রাম, আরাম। আয়েশা (রা.) বর্ণিত, ‘প্রিয়নবী (সা.) চার রাকাত করে নামাজ পড়তেন এবং বিশ্রাম নিতেন।’ আর বিশ্রাম বা বিরতির অপর নাম ‘তারাবি’। শব্দটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত-সুপরিচিত পরিভাষা হলেও পবিত্র কোরআন-হাদিসে তা পাওয়া যায় না। ‘কিয়ামুল লাইল’ ‘কিয়ামুর-রামাদান’ ‘তাহাজ্জুদ’ ইত্যাদি দ্বারা রমজানের রাতের বিশেষ নামাজ-ইবাদত বোঝানো হয়েছে। রমজানের রাতের বিশেষ নামাজকে ‘তারাবি’ বলবার তাৎপর্যকে সহিহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী, সহিহ বুখারির ভাষ্যকার আল্লামা কিরমানি, মিশকাতের ভাষ্যকার আল্লামা ওবায়দুল্লাহ রহমানি প্রমুখ সমর্থন করেছেন। বাঙালি সমাজে তারাবির অর্থগত তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি সমাজে তারাবির অর্থ খানিক তাড়াতাড়ি। তবে আত্মিক প্রশান্তির বিষয়টি ঠিকই পাওয়া যায়। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা খেটে খাওয়া বাঙালি মুসলমানের জন্য তারাবি ও তারাবির নামাজে কোরআন শ্রবণ এক অপার্থিব প্রশান্তি লাভের কারণ। শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে তারাবি নামাজে তিলাওয়াতের মানও দিন দিন উন্নত হচ্ছে।
ইসলামী শরিয়তে তারাবি নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের উপস্থিতি এবং সময়ের দীর্ঘতা বোঝানোর জন্য হাদিসে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ্ রমজানের রোজা ফরজ করেছেন এবং রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করার (তারাবি) বিধান করেছেন। (ফিকহুস-সুন্নাহ)
প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ রমজানের রোজা ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য রাত্রি জাগরণ (তারাবি) সুন্নাত করেছি। সুতরাং যে ঈমান ও নিষ্ঠার সঙ্গে (সাওয়াবের আশায়) রোজা রাখবে ও রাত জেগে থাকবে নামাজরত অবস্থায় সে যেন নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে গেল। (মুসনাদে আহমদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ)
বিনা কারণে তারাবি ত্যাগ করা সুন্নাত ছেড়ে দেওয়ার নামান্তর এবং তা গুনাহের কারণ। তারাবির নামাজের গুরুত্ব বিবেচনা করে মুসলিম বিশ্বে রমজানের আগে মসজিদগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখা যায়। মসজিদের উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়। বাঙালি মুসলিম সমাজেও সে রেওয়াজ চালু আছে। তারাবির ইমাম হাফেজদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, তাঁদের জন্য সামান্য সম্মানির ব্যবস্থা করা এবং তারাবির জামাতের সময় মুসল্লিদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল করে নানাবিদ উদ্যোগ দেখা যায়। আর এর সবই হয় উৎসবমুখর পরিবেশে; এমনকি কারো কোনো দিন তাবারি ছুটে গেলে আফসোস করতে, আপনজন কর্তৃক তিরস্কৃত হতেও দেখা যায় বাঙালি মুসলিম সমাজে। রমজান শেষে পবিত্র মাসের যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই ঈদ উদ্যাপন করে তারা। বস্তুত রমজানকে যথাযথভাবে প্রতিবছর তাবারি বাঙালি মুসলিম সমাজে ধর্মচর্চায় একটি গভীর রেখাপাত করে যায়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, MvRxcyi prof.ershad92@gmail.com