এদিকে রাজার রাজকার্য্যে মনোনিবেশ করিতে পারছেন না। তিনি শুধু তার সন্তানের চিন্তায় আধমরা হয়ে বসে থাকেন। মন্ত্রী উজিররা এ সুযোগে সামান্য অজুহাতে বাড়ীতে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কোন কিছু যেন কারও দেখার নেই। রাজ্যের পন্ডিতগণ রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পন্ডিত গণ রাজাকে বললেন, আপনি দ্রুত আশে-পাশের রাজ্যে দুত পাঠান দয়াল কুমারকে খোজ করার জন্য। আপনি যেহেতু সন্তানের জন্য কাতর , তাহলে তাদের নিয়ে এসে তাদের সম্পর্ক কে রাজকীয় মর্যাদায় মেনে নিন। তখন রাজা বলেন জী পন্ডিত মশাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি , তাদের সম্পর্ক মেনে নিতে। পন্ডিত গন বলেন ঠিকই স্দ্ধিান্ত নিয়েছে হাজার হলেও সে আপনারই সন্তান। সে তো কোন দু-স্কৃতির ঘরে সম্পর্ক করেনি। সহজ সরল গরীব পরিবারের এক বুদ্ধিমতী সাহসী মেয়েকে বিয়ে করেছে।
স্কুলের মাষ্টারের কাছে আমরা শুনেছি, মেয়েটি খুব মেধাবী এবং সৎ মানুষ। আমাদের দয়াল কিন্ত আসল মুক্তা ই সংগ্রহ করেছেন । আপনি ইচ্ছা করিলে, তাকে পড়াশোনার সুযোগ ও করে দিতে পারেন। তাহলে, লেখাপড়া শিখে দয়ালের সাথে সে ও রাজকার্য্যে অংশ গ্রহন করিতে পারিবে। রাজা বলেন, আগে তাদের খুজে আনাতো হোক। তারপর সে সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন পন্ডিত গন রাজাকে বলেন, আপনি বরং মায়াবতীর বাবাকে বলুন, তারা কোথায় আছে? তাদের নিয়ে আসুন। তাদের বিয়ে মেনে নেয়া হবে। তখন রাজা বলে, তারা নাকি জানেনা। তার মেয়ে টা দয়ালএর সাথে কোথায় রয়েছে। জৈষ্ঠ পন্ডিত মশাই বলে, আপনার অত্যাচারের পূর্ব ঘটনার জেরে হয়ত সে চেপে আছে। আপনি বরং, তাদের রাজপরিবারে দাওয়াত করে রানীমাকে দিয়ে কাজটি করাতে পারেন। তখন রাজা ও রানী পরেশ কাঠুরের বাড়ীতে মিষ্টি সহ অনেক উপঢৌকন নিয়ে যায়। রাজাকে দেখে পরেশ মাথা নিচু করে সালাম জানিয়ে বলেন, রাজা মশাই আপনাকে যে কোথায় বসতে দেই?
তখন পরেশের স্ত্রী দুটো কাঠের চেয়ার তাদের সামনে এনে বসতে বলেন এবার আপনি অন্য কোন মতলবে এসেছেন? জানিনা! আমাদের মত গরীব ঘরে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোই এক অপরাধ! কতদিন পর একটু বিদ্যা শিখে, শেষে প্রেম নামক খেলায় ধনীর দুলালে গেড়াকলে আটকে যায় । যার ধরুন তার পিতা-মাতাকে এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে । ভুলটা যেন শুধু মেয়ে আর মেয়ের বাবা-মাই করেছে? ছেলের কোন দোষ নেই? ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আমি যদি আজ আপনার জায়গায় থাকতাম? তাহলে তো আপনার ছেলে কে আমার মেয়ে অপহরনের অভিযোগ ঠিকই জানাতে পারতাম। তখন রাজা মশাই কোন কথা বলে না। শুধু মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে। তখন রানীমা বলে ওকে আর অপমান করিবেননা। ও যদিও আপনার মেয়ে ও আপনার সাথে অনেক অপরাধ করেছে। তিনি এখন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তিনি তিন/চারদিন হলো সন্তানের জন্য রাত্রিতে দুচোখের পাতা এক করিতে পারছে না। তিনি দয়াল-মায়াবতীর সম্পর্ক মেনে নিবেন। তাই আমরা আপনার নিকট এসেছি ওদের খোজ করার জন্য। পরেশ বলে ওদের খোজ করে নিয়ে এসে তাদের ভবিষ্যত জীবন ধ¦ংশ করিবেন না তার কি নিশ্চয়তা আছে? রানীমা বলে আমি তার নিশ্চয়তা। আমি থাকতে কেউ ওদের আর ঠেকাতে পারবেনা। তখন রাজা মশাই বলেন, দাদা আমি আপনার কাছে একদম ছোট হয়ে গেছি ।
আমার ভিতর অহংকার বংশের মর্যাদা নামক ভুত চেপেছিল । আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমরা সবাই মাটির তৈরী একই রক্তে মাংসে মানুষ। সবার উপর মানুষ সত্য, ত্হাার উপর নাই, এই কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি বলে রাজামশাই পরেশের হাত চেপে বলে, আমাকে ক্ষমা করিবেন। তখন পরেশ বলে, একি রাজা মশাই একি করছেন, আপনি হলেন, আমাদের রাজা, আর আমি হলাম সামান্য প্রজা, আমার হাত ধরে ক্ষমা চাচ্ছেন? রাজা বলে না ভাই আমাকে আর জব্দ করিবেন না। আপনি এখন আমার পরম আত্নীয় । তখন পরেশ রাজা কে বলে, ঠিক আছে আমি আপনাদের কথামত দয়াল আর মায়াবতীকে খুজে বের করে নিয়ে আসবো, আমি কথা দিচ্ছি। কিন্ত ভগবানের দোহাই, এনে আমার মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে অলংকৃত করিতে হবে। তখন রাজা ও রানীমা বলেন, আমাদের ভিতর আর কোন রাগ-গোষা নেই। আমরা আমাদের ছেলে আর ছেলে বউকে বরন করার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি। অন্যদিকে দুপুরের খাবার খেয়ে মাসিকে বলে, আমরা দুজন একটু ঘুরতে বেড়াবো। মাসি বলে ঠিক আছে যাও সন্ধার আগেই কিন্তু চলে এসো। দুজনে বাড়ীর উত্তর পাশের সড়ক বেয়ে হাটতে থাকে ।
দয়াল কুমার চন্ডিপুর গ্রামের সড়কের পাশে কাশফুল ছিড়ে এনে মায়াবতীর খোপায় গেথে দিয়ে সড়ক দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সড়ক দিয়ে হাটতে হাটতে প্রায় তিন-চার কিলোমিটার দুরে চলে গেছে অন্য গ্রামের ভিতর। চারিদিকে কদমগাছের ফুলের সমারোহ এবং এক পাশে আপনা আপনি গজে উঠা কাশফুলের গাছ দেখ তে দেখতে আপন মনে দুজন মাসি বাড়ী হতে অনেক দুরের গ্রামে চলে যায় । হঠাৎ সড়কে তাদের পায়ে হাটা গতিরোধ হয়।সড়কের পাশে ছিল বিশাল নদী। সেই নদীর বাধ হিসেবে ব্যবহ্রত হছ্ছে এই সড়কটি । এই নদীর পানির ¯্রােতে সড়কে মাঝ খানে ভেঙ্গে গেছে। সেখানে বসে দুজন পানির স্রোত দেখছে ছোট ছোট মাছের লাফালাফি এবং শুশুকএর উল্টোলাফ দেয়া দেখছে। ভেঙ্গে যাওয়া অংশ ছিল সামান্যই। কিন্ত স্রোত ছিল অত্যাধিক। ভাঙ্গার অংশের ঐ পাড়ে সড়কের পাশে অস্থায়ী তাবু গেড়েছে বেঁদে পল্লীর লোক জন। সেখানে তাদের কিচির মিচির শব্দ তাদের কানে আসছিল। তখন মায়াবতী দয়ালকে বলছে চলনা ঐ পারে যাই। ওখানে লোকজন সাপের খেলা দেখছে আবার ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে। তখন দয়াল বলে ওখানে গেলে তো পানিতে ভিজে যেতে হবে। মায়াবতী বলে চল না ভিজেই যাই। দয়াল পানিতে নেমে দেখে পানি হাটুর একটু বেশি পানি। তাই দয়াল তার পরনের প্যান্ট একটু হাটু পর্যন্ত ঘুচিয়ে নিয়ে মায়াবতীকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে পানিতে নামে ওপার যাওয়ার জন্য । দয়াল মায়াবতীকে নিয়ে ওপারে উঠবে এমন সময় বিপরীত দিকে তেড়ে আসা একটি বিষাক্ত সাপ দয়াল কুমারকে ছোবল মারে এবং চলে যায় ।
দয়াল কুমার একটু উ: বলে উঠে,তারপর ও মায়াবতীকে আলতো করে নিয়ে সড়কে উঠে মায়াবতীকে কোল হতে নামায় । তার পর তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে, পায়ে সামান্য আচড় লেগেছে। মায়াবতী তার পায়ে আচড় দেখে চিন্তিত হচ্ছে? সে ভাবে কোন পোকা-মাকড় তো কামড় দিল না। সে বলে চলো সাপুড়েদের মধ্যে অনেক কবিরাজ আছে, তাদের দেখাই। তখন দয়াল বলে রাখ তোমার কবিরাজ, এটা সাপে কাটার আচড় নয় । হয়ত কোন জঙ্গলের সাথে লেগে এমন হয়েছে । এটা এমনি ঠিক হয়ে যাবে। তখন তারা বেঁদে পল্লীর ছোট্র কুটির গুলোর গলি দিয়ে হাটছে আর সেখানকার ছেলে-মেয়েদের খেলা , বেঁদে গৃহবধুর পাখি জবাই করে রান্না করার দৃশ্য আবার অন্য খানে সাপের খেলা দেখে । এরই মধ্যে দয়ালের সারা দেহে সাপের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ করে এক সময় দয়াল অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় । তখন মায়াবতী তাকে তার কোলের মধ্যে মাথা রেখে বলে, এই তোমরা কে কোথায় আছো? আমার দয়ালকে বাচাও । তখন বেঁদে পল্লীর এক বৃদ্ধ সাপুড়ে এগিয়ে এসে বলে মা এ কে ? ওর কি হয়েছে? তখন মায়াবতী বলে বাবা ও আমার স্বামী । আমরা দুজন ঐপার হতে আসার সময় ওর পায়ে কিযেন আচড় দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আপনাদের দেখানোর জন্য । কিন্ত ওর চাপাচাপির কারনে দেখাইতে পারি নাই। তখন বৃদ্ধ সাপুড়ে দয়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, মা ওকে তো বিষাক্ত সাপ কামড়িয়েছে। ওকে ঝাড়ফুক দিতে হবে। দেখা যাক ভাল করা যায় কিনা? মায়াবতী বলে, বাবা আপনি আামার স্বামীকে বাঁচান। ও ছাড়া এ দুনিয়াতে আমি একা। ওকে ছাড়া বাচবোনা। তখন বৃদ্ধ সাপুড়ে বলে, মা তুমি উপরওয়ালাকে ডাকো। সেই পারে তোমার স্বামীকে বাচাতে।
তখন বৃদ্ধ তার তাবু হতে একটি ধারালো ব্লেট এবং কিছু গাছের মোথা নিয়ে আসে। দয়ালের যেখানে আচড় লেগেছে, সেখানে ধারালো ব্লেট দিয়ে সামান্য কেটে রক্ত বের করে তার পর সাপুড়ে মুখ দিয়ে রক্ত চুষে বের করে অনেক্ষন । শেষে ক্ষতস্তানে গাছের মোথার রস চেপে লাগিয়ে দেয় । ঘন্টা দুয়েক অতিবাহিত হওয়ার পরও দয়ালের জ্ঞান ফেরে না। এমনকি রাত্রী দশটা বেজে যায় তার পর ও তার জ্ঞান ফেরেনি। মায়াবতী তো তার পাশে বসে শুধু কাদছে কাদছে। শেষে রাত্রী এগারটার সময়, বৃদ্ধ সাপুড়ে ুবলে তার পক্ষে এরোগীকে ভাল করা সম্ভব নয় । সেই গ্রামে কোন হাসপাতাল বা ডাক্তার নেই। হাসপাতাল রয়েছে সেই নদীর ওপার জগন্নাথপুর শহরে। এখনকার গ্রামের মানুষ গ্রাম্য কবিরাজ ই বিশ্বাস করে থাকে। এছাড়া তাদের কোন উপায় নাই। শেষে মায়াবতী বৃদ্ধ সাপুড়ের অপারগতা শুনে কাদছে আর বলছে তাকে ভাল করার কি কোন উপায় নেই। তখন বৃদ্ধ সাপুড়ে বলে একটি উপায় আছে, ভেলা বানিয়ে সেখানে মা মনসার পুজা করে সেই ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হবে। ভাসতে ভাসতে মা মনসার কৃপায় যে সাপ তাকে কামড়িয়েছে, সেই সাপ তার কাছে এসে বিষ নামিয়ে নেবে । এই ভাবে তোমার স্বামী তার প্রাণ ফিরে পাবে।
তখন রাত্রী বাজে দুই টা । সে কোন কুলকিনারা না পেয়ে তাদের বলে সে ব্যবস্থা করার জন্য। তখন বেদেঁ পল্লীর লোকজন ভেলাতে পুজা সাজিয়ে দয়ালকে ভাসিয়ে দেয় । এমন সময় মায়াবতী ভাবে দয়ালের যে গতি হবে তারও সেই গতি ভেবে সে দৌড়ে পানিতে ঝাপদিয়ে ভেলা ধরে ভাসতে থাকে। লোকজন মেয়েটিকে উদ্ধার করিবে চিন্তা প্রস্তুত হতে হতে পানির ব্যাপক স্রোতে তারা অনেক দুরে ভেসে চলে যায় । তখন উপস্থিত বেদে পল্লীর লোকজন মেয়েটির জীবন শংকা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। ওদিকে মায়াবতীর বাবা তার ছোট ভাইকে মায়াবতী আর দয়ালকে নিয়ে আসার জন্য চন্ডিপুর পাঠায়। (চলবে)