নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুই সপ্তাহ আগে থেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ করোনা থেকে রক্ষার সব সুরক্ষাসামগ্রীর দাম। করোনা মহামারির মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর দাম। হঠাৎ করেই অক্সিজেনের সিলিন্ডার যেন সোনার হরিণ। করোনাকে পুঁজি করে সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ। ওষুধসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে। নানা অজুহাতে ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন দোকানিরা। এতে অনেকটাই দিশেহারা মানুষ। এ পরিস্থিতিতে ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে বড় ধরনের অভিযানে নেমেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি জেলায় এ অভিযান চালানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই সপ্তাহ আগে থেকে করোনার রোগী বেড়ে যাওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ করোনা থেকে রক্ষার সব সুরক্ষাসামগ্রীর দাম। আর গত দুই মাস ধরেই ওষুধের বাজারে আগুন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ওর্ যাব পৃথক অভিযান চালালেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠিত করোনা টাস্কফোর্স সভা হয়। সেখানে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সব কর্মকর্তা অংশ নেন। বাজারে ওষুধ, স্যানিটাইজার ও মাস্কসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর বাজার ঠিক রাখতে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সভায়। সেখানে পরিচালকের (প্রশাসন) তত্ত্বাবধানে প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাসুম আরেফিন, বিকাশ চন্দ্র দাস এবং ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডলসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে অভিযান পরিচালনার জন্য এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। গতকাল ঢাকা মহানগরীর কলাবাগান, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় বিভিন্ন ফার্মেসি এবং বিএমএ মার্কেটে অভিযান চালানো হয়। এ ব্যাপারে টাস্কফোর্সের প্রধান বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে মোড়কে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে যারা ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি করবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেজন্য মাঠে নেমেছে মনিটরিং টিম। এবার শাস্তির পরিমাণ বেশি হবে।’ ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে তৈরি ওষুধ বিদেশি নামকরণ করে বেশি দামে বাজারজাত করছেন এমন অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর বেশ কয়েকটি কারখানা সিলগালা করা হয়েছে।
শুধ তাই নয়, ওষুধের গায়ে দাম মুছে দ্বিগুণ-চারগুণ দাম নতুন করে বসিয়ে বিক্রি করছে ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। গত দুই সপ্তাহ রাজধানীর মিটফোর্ড, ঢাকা মেডিকেল কলেজের হসামনে, শাহবাগ, ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মুগদা, গুলশান, মিরপুর, বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে এমন দ্বিগুণ বা কোথাও চারগুণ দামে বিক্রি করার জন্য ওষুধ ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরা হয়। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বাবুল কুমার সাহা বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রীর বাজার ঠিক রাখতে নিয়মিত বাজার অভিযান ও মনিটরিং করা হয়। কিন্তু করোনা আক্রান্ত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় অভিযানের মাত্রাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অভিযানে যৌক্তিক মূল্যে ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জামাদি বিক্রি করতে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে কি না- তা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে। এবারের অভিযানটি একটু ভিন্ন কৌশলে হবে বলে জানান তিনি। জানা গেছে, আইভেরা ৬ এমজি ৭.৫০ টাকার ট্যাবলেট ১৫ থেকে ১৭ টাকা, জিংক ২৫ টাকার ট্যাবলেট ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ১৮ টাকার নাপা এক্সট্রা ৩০ টাকা, ফেক্সেফেনাডিল ১০০ টাকা, ৪০ টাকার মনটিন ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, স্কয়ারের নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, নিউরোক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা, রসুভাস ১৫০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, টোসার ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, অ্যাডোভাস ৫৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে হাড় ক্ষয়ের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয় এমন ওষুধের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। অস্টিওপোরোসিসের ওষুধ হিসেবে বয়স্করা বেশি ব্যবহার করছেন আইব্যান্ড্রনিক অ্যাসিড জেনেরিক ১৫০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট ফরম্যাট। এতদিন প্রতিটি ট্যাবলেট বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। তবে হঠাৎ গত এক-দেড় মাসে এই ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। অপসোনিন ফার্মা লিমিটেডের বনফিক্স ব্র্যান্ডের ওষুধটি ৫০০ থেকে চলতি মাসে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই জেনেরিকের বন্ড্রোভা ব্র্যান্ডের হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধটির দাম বেড়ে এখন ১৯৬০ ও ল্যাবএইড ফার্মার বোনাইড ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিন ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও সিরাপ বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ-চারগুণ দামে। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দামেও নিয়ন্ত্রণ নেই। ভোক্তা অধিকার উপ-পরিচালক বলেন, এই মুহূর্তে ওষুধের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম যেমন বাড়েনি তেমন এমন কোনো কারণ ঘটেনি যে, কোনো ওষুধের দাম বাড়াতে হবে। তবে চিকিৎসকদের কমিশন ও উপহার দেওয়ার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়ানোকে নিরাপদ মনে করছে।
জানা গেছে, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ওষুধের দোকানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এখানকার ৪৪টি বাজার থেকেই মূলত পাইকারি হারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওষুধের সরবরাহ করা হয়। এ ব্যাপারে ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির উপসচিব মনির হোসেন বলেন, গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য অনেক ব্যবসায়ীর ওপর অযৌক্তিক জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যমতে, দেশে ২০০টির মতো ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে। আর এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি কোম্পানি মানসম্মত ওষুধ প্রস্তুত করে থাকে।