চন্ডিপুর একটি পাহাড়ী গ্রাম। এ গ্রামে রাস্তাগুলো পাহাড়ে মাঝ খান দিয়ে কোথাও আবার পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে একে বেকে রয়েছে । পাহাড়ের ঢালের জমিতে পাহাড়ীরা ঝুম চাষ করে থাকে। কিছু কিছু জায়গায় চা বাগান রয়েছে বিশাল এলাকা জুরে। এসব বর্ণনা মায়াবতী দয়াল কে বলছে। এ গ্রামের বৈশিষ্ঠ অনেক পুর্বেই তার মাসতাতো ভাইয়ের কাছে শুনেছিল মায়াবতী । কিন্ত তার মাসতাতো ভাইটা আজ বেচে নেই। মায়াবতী তার মাসতাতো ভাইয়ের শুন্যতা অনুভব করছিল। সে মনে মনে ভাবে মাসতাতোভাইটা থাকলে তাকে সাথে ও দয়ালের সাথে নিয়ে কত না আনন্দে এ গ্রামের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি উপভোগ করিতে পারতো। যা হোক সেদিন তার চাচা আছে বলে মায়াবতী আর সন্ধায় ঘুরতে বের হওয়ার কথা বলল না। কেননা এমনি নৌকা ডুবিতে ভীষন বেগ পেতে হয়েছে। তার পর ঘুরতে বের হওয়ার বায়না ধরিলে, তার চাচা তাকে বকা দিতে পারে।
তাই মায়াবতী বলছে, আগামীকাল চাচা বাড়ী রওনা হলে, আমরা দুজন গ্রামে ঘুড়তে বের হবো। গ্রামে ঘোড়া দৌড়, নৌকা বাইচ, হাডুডু খেলা আর ও কতকি জানো জানো এ গ্রামে জামাইমেলা ও বসে। অন্যদিকে দয়ালের পিতা রাজা মহাশয় পেয়াদা পাঠিয়েছে দয়ালের খোজ করিতে। পেয়াদা এসে দয়ালকে দেখতে না পেয়ে এবং মায়াবতীর পরিবার দয়াল-মায়াবতীর সন্ধান দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় পেয়াদা রেগে-মেগে রাজ দরবারে চলে যায় । রাজার পেয়াদার নিকট শুনতে পেয়ে সে রাজদরবারে পরেশ কাঠুরে কে তলব করেন। পরেশ কাঠুরে রাজদরবারে উপস্থিত হলে, রাজা জানতে চান তার ছেলে দয়াল কুমার কোথায় বা তাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো বল। পরেশ কাঠুরে হাত জোর করে বলে, রাজা মহাশয়, ওরা সাবালক মানুষ, ওরা বিয়ে নিজে নিজে বিয়ে করেছে। আপনাকে যেমন জানায়নি, ঠিক তেমনি আমাকেও তো জানায়নি। জোর করে আপনার ছেলে আমার বাড়ী হতে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছে। এখন কোথায় আছে, তা আমি জানি না। রাজার মন্ত্রী বলে রাজা মশাই এমনি তে বলবেনা! আঙ্গুল বেকা না করিলে যেমন ঘি উঠে না, এসব ছোটলোক কে কিছু সাহেস্তা না করিলে কাজ হবে না। রাজা তখন পেয়াদাকে বলে, মেরে ও মুখ খোলার ব্যবস্থা কর।
পেয়াদা তখন পরেশ কাঠুরে কে চাবুক দ্বারা পেটাতে থাকে আর বলে, বল ওরা কোথায় রয়েছে । পরেশ কাঠুরে তার মেয়ে-মেয়ে জামাইএর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মুখ বুঝে চাবুকের আঘাত সহ্য করতে থাকে। এভাবে অনেক্ষন চাবুকের আঘাত চলছে। কিন্ত পরেশ তার সিদ্ধান্তে অটল। পরেশের মুখ থেকে কোন কথা বের না করতে পেরে রাজা রেগে কটমট করতে করতে রাজ দরবার হতে বের হয়ে যান । সারা দিন নির্যাতন চলছে । রানী রাজ দরবারে এসে পেয়াদাকে বলে এসব বন্ধ কর। ওনার মেয়ের যেমন অপরাধ,তেমনি আমাদের ছেলে তো ওদের বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করে অপরাধ করেছে। এর জন্য শুধু ওকে নির্যাতন করে লাভ কি? ও যদি জানত তাহলে তো বলেই দিতো। এতো নির্যাতনের মধ্যে কেউ কি চুপ করে থাকে। ওকে ছেড়ে দাও। পেয়াদা বলে ওকে ছেড়ে দিলে আমার চাকুরী থাকবেনা। রানী মা এটা রাজা মহাশয়ের আদেশ । রানী বলে, যা হয় আমি দেখব। আমি এ রাজদরবারের রানী হয়ে বলছি, তুমি একে ছেড়ে দাও। তারপর তোমরা সারা রাজ্যে ব্যাপক ভাকে তল্লাশি কর , ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে। কিন্ত ওদের গায়ে যেন কোন আচড় না পড়ে। সযতে ওদের কে রাজদরবারে নয় রাজ পরিবারে নিয়ে আসবে। রানীর কথামত পেয়াদা পরেশ কাঠুরে কে ছেড়ে দেয় । পরেশ কাঠুরে রানী মাকে সালাম কুর্নিশ করে বলে, আপনি একজন ভাল মানুষ, আপনার উপকার কখনও ভুলব না। কিন্ত আপনার কাছে আব্দার রাজার কবল হতে ওদের বাচান। ওরা দুজন অবুঝ শিশু। ওদের কোন দোষ নেই। বিধাতা প্রদত্ত ভালবাসায় সিক্ত হয়ে মা কালির আশির্বাদ পুষ্ট হয়ে তারা বিয়ে করেছে ।
রানীমা তাকে আশস্ত করে বলেন, আমি এবার কঠিন সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হবো। আপনি চিন্তা করিবেন না। আমি আমার বৌমাকে বরন করার জন্য প্রস্তত আছি । দেখি উনি কতদুর পর্যন্ত যেতে পারে। রানী এসব কথা শুনে যেন পরেশের গায়ে চাবুকের ব্যাথা নিমিষে সেরে গেল । সে বাড়ীতে গেলে পরেশের স্ত্রী বলে তুমি এমন হেংলা হয়ে হেটে আসছো কেন? তোমার কি হয়েছে? তুমি সেই সকালে গেলে সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই, সন্ধা গড়ে রাত্রী হয়ে যাচ্ছে । চলো তুমি খাবে। পরেশ ঘরের ভিতর গিয়ে জামা খুলে বিছানায় শরীর আলতো ভাবে এলিয়ে শুয়ে পড়েছে । তখন মায়াবতীর মা তার গায়ে জখমের দাগ দেখে বলে এ তোমার কি হয়েছে? কে এমন ভাবে তোমাকে মেরেছে ? তখন পরেশ চোখের পানি টপ টপ করে ছেড়ে বলছে, মায়াবতী আর দয়াল কুমারের সন্ধান জানার জন্য রাজা ডেকে নিয়ে পেয়াদা দিয়ে পিটিয়েছে । তখন মায়াবতীর মা বলে তুমি কি ওদের সন্ধান বলে দিয়েছো? পরেশ বলে হাজার হলেও একটি মাত্র মেয়ে তার সুুেখর জন্য তার ভালবাসা অটুট রাখার জন্য এসামান্য আঘাতে বলতে পারি। জীবন গেলেও বলবোনা। তখন তার স্ত্রী বলে তাহলে তোমাকে ওরা ছেড়ে দিল যে !
তখন পরেশ বলে জানো মায়াবতীর মা দয়ালের মা রানীমা আমার মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নিবে বলে তিনি আমাকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন এ জন্য রাজাকে প্রতিনিয়ত বুঝাচ্ছেন। তখন মায়াবতীর মা বলে বুঝলেতো ভালই হতো। মেয়েটার দু:খ ঘুচত। কতদিন হলো সেই চন্ডিপুরে পড়ে আছে। জানি না কেমন আছে । পরেশ কাতরাতে কাতরাতে অল্প কিছু দানা পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার স্ত্রী সরিষার তেল নিয়ে স্বামীর আঘাতে চিহ্ন গুলোতে ঘষতে থাকে। এভাবে তারা ঘুমিয়ে পরে। অপর দিকে সেই সুদুর চন্ডিপুরে বিদ্যুৎ এর আলো বিহীন ঘরে দয়াল কুমার আর মায়াবতী শুয়ে আছে । ঘরে একটি কেরোসিনের বাতি দেওয়া আছে । কেরোসিনের বাতির আলোতে বসে – শুয়ে তারা প্রেমালাপ করছে। মায়াবতীর চাচা বাহিরের বারান্দায় অতিথিদের জন্য বানানো ঘরে শুয়ে আছে । সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়াবতী বলে মাসি চাচা কে খেতে দাও । চাচা তো বাড়ীতে চলে যাবে , যাতে করে ফাস্টটিপের নৌকায় যেতে পারে। মায়াবতীর মাসি বলে, তোর এতো তাড়া কেন, এসেছে কয়েকদিন থাক না।
দুইদিন পর এখানে নৌকা বাইচ হবে। দেখে যাবে। মায়াবতীর চাচা বলে নানা বিয়ান , বাড়ীতে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে । বাড়ীতে ভাই একা সব কিছু এক সামাল দিতে পারিবেনা। একটু সকালের নাস্তা সেরে ই চলে যাবো। মাসি বলে না বিয়ান আপনি হঠাৎ করে আসলেন এখনি চলে যাবেন, তেমন আপ্যায়ন করতে পারলাম না। তখন মায়াবতীর চাচা বলে না অনেক হয়েছে । আবার আসবো। মায়াবতীর চাচা সকালের নাস্তা সেরে সকলকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। (চলবে)ূ