দরিদ্রতা, জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব মূলত এই পৃথিবীতে অশান্তির কারণ। এই অশান্তিকে যদি শান্তিতে রূপান্তর করতে হয় তাহলে দরিদ্রতা, জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব পৃথিবী থেকে দূর করার বিকল্প নেই। কথাটি বলা সহজ হলেও এর প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, যা আমরা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অতিমাত্রায় পরিলক্ষিত করছি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলকে পরাধীনতার শৃ ঙ্খল থেকে মুক্ত করে দরিদ্রতা, জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব দূর করে বৈষম্যহীন একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে রূপান্তর করা। এই আশা থেকে বঙ্গবন্ধু দেশ ভাগের আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে আশাহত হলেন।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বর্তমান পাকিস্তান বহাল রেখে বাঙালি জাতি থেকে দরিদ্রতা, জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব দূর করে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হবে না। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি জাতি প্রকৃতপক্ষে এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে অন্য আরেক ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হচ্ছে। যার ফলে এই অঞ্চলে দরিদ্রতা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে যা এক সময়ে জাতিগত দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করতে পারে। সেই সময় থেকে বাঙালি জাতির পিতা বাঙালি জাতির শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় ছিলেন শান্তি ও শোষিতের পক্ষে। তিনি কখনোই সহিংস আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন, ৬৮’র আগরতলা মামলা প্রতিহতকরণ, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এ সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। সেই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক, অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন। ইউনেস্কো এই ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতের ডাক দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে সেই ভাষণে শান্তির ডাক দিয়েছেন যার মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের শুরু হয়। যা বিশ্বের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এখানে অর্থনৈতিক মুক্তি হচ্ছে দরিদ্রতা দূরীকরণ এবং স্বাধীনতার ডাক হচ্ছে একটি জাতি রাষ্ট্রের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
এরই একটি পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। একই রাতে জাতির পিতা এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতির পিতার নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে বাঙালি জাতি। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশর। শুরু হয় অর্থনৈতিক মুক্তির এক নতুন বিপ্লব।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বাঙালি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়- এই মতবাদে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর থেকে বড় উদাহরণ আর একটিও আছে বলে আমার মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ বা মতবাদ থেকে একচুলও পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যা আমরা দেখতে পেয়েছি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংঘাতের ক্ষেত্রে যার সমাধান তিনি শান্তিপূর্ণভাবে করে যাচ্ছেন এবং ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে তিনি বছরের পর বছর খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। রোহিঙ্গারা যেন এই অঞ্চলে সুন্দর, সুস্থ ও শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন শুধু মাত্র শান্তি রক্ষার জন্য।
ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২ এই চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে বাঙালি জাতির পিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু সরকার কতৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় একটি আদর্শ দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরীব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিগত বৈষম্য ও দরিদ্রতা দূরীকরণ এবং মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছেন। যেই দেশ থেকে আমরা মাত্র কয়েক বছর আগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি সেই দেশেও তিনি গিয়েছেন। শুধু মাত্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ব থেকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। অনেকে এর সমালোচনাও করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো। তার শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে তিনি বাংলাদেশকে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ করিয়ে দিয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের সুনাম অর্জন করেন। এ সব বিষয়ের জন্য ও বিশ্ব মানবতায় অবদান রাখার কারণে বাঙালি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার স্থপতি গণতন্ত্র ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারিকুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের হো চি মিন, প্যালেসটাইনের ইয়াসির আরাফাত, চিলির সালভেদর আলেন্দে, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরাগান্ধী, মাদার তেরেসা, চিলির কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, ভারতের জওহরলাল নেহেরু, আমেরিকার মার্টিন লুথারকিং, রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্বনেতাদের এই পদকে ভূষিত করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদের শান্তি পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। এ মহান অর্জনের ফলে জাতির পিতা পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে।
এই পদকটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান। তার এই পদকপ্রাপ্তি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে অন্যান্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসংস্থার কাছ থেকে স্বীকৃতি ও সদস্য পদ লাভ ত্বরান্বিত হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই শান্তি পদক সম্পর্কে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত হওয়া ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, দরিদ্রতা, সংঘাত এবং বৈষম্য দূরীকরণে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত হতো এবং সমৃদ্ধ হতো গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধীরা সপরিবারে হত্যা করে আমাদের জাতির পিতাকে। ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করে জাতির পিতার আদর্শকে। কিন্তু জাতির পিতার নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
যদিও, জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব এখন আর বাংলাদেশে নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি বা দরিদ্রতা দূর করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে একটি কল্যাণমুখী মহামারি উপযোগী একটি বাজেট তিনি ঘোষণা করবেন যার ফলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রশান্তি বজায় থাকবে। এই করোনার মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে গত এক বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রগতি হয়েছে। এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলার। যা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই মহামারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশকেও ওষুধ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উপহার দিচ্ছেন যার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রক্রিয়া বজায় রয়েছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা ও বিশ্বাসে জাতির পিতার আদর্শ যে গভীরভাবে প্রোথিত তা বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তার নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়াই প্রমাণ করে। যার অনু প্রেরণা ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ‘জু লিও কু রি’ পদকপ্রাপ্তির মাধ্যমে শুরু হয়ে ছিল। আমরা যদি আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর শান্তিপূর্ণভাবে জাতিগত ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব নিরসনের আদর্শ মেনে চলতে পারতাম তাহলে আজকের বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশাল অগ্রগতি সাধিত হতো।
লেখক :উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবু র রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ.
#চলনবিলের আলো / আপন