জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে ১৮ বার জেলে গেছেন। আর জেলে কাটিয়েছেন সাড়ে ১১ বছর, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুইবার। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মাথায় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অভিযোগে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।
কারা অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’। এটি বঙ্গবন্ধুর লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ২০১৭ সালের মার্চে গ্রন্থটি প্রকাশ করে।
১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সময় পর্বের কারাস্মৃতি এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে তাঁর লেখা দুটি ডায়েরি জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধার করা একটি ডায়েরির গ্রন্থরূপ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত এই ‘কারাগারের রোজনামচা’। সমকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা, বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনা, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বস্তুনিষ্ঠ, প্রাঞ্জল ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এ গ্রন্থে।
শুরুতে নাতিদীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি শুনিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর লেখার খাতাগুলো উদ্ধারের গল্প।
রোজনামচায় যাওয়ার আগে ‘থালা-বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল’ শীর্ষক অংশে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জেলখানার নানা নিয়ম-কানুন আলোচনা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, বন্দিরা সপ্তাহে একটি চিঠি আর ১৫ দিনে একবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারত। কিন্তু সেখানেও বাধা-নিষেধ ছিল। গোয়েন্দা দপ্তরের কর্মচারীদের পড়ার পর চিঠি হাতে পাওয়া যেত, সাক্ষাতের সময় গোয়েন্দা ও জেলের কর্মচারীরা উপস্থিত থাকত।
বাঙালির মুক্তি সনদ খ্যাত ছয় দফা আন্দোলন নিয়ে পাওয়া যায় বিস্তারিত তথ্য। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় কনভেনশনে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনে বঙ্গবন্ধু জানপ্রাণ দিয়ে নেমে পড়লে পাকিস্তান সরকার জেল-জুলুম ও অত্যাচারের পথ বেছে নেয়। দেশরক্ষা আইনে একের পর এক তাঁকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে রাতে গ্রেপ্তারের আগে ২০ মার্চ থেকে ৭ মে পর্যন্ত তিনি ৩২টি জনসভায় ভাষণ দেন। ৫০ হাজার লিফলেট ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ছয় দফার দাবিতে ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। নজিরবিহীন হরতাল পালন করে। হরতাল পালনকালে সারা দেশে সরকারি বাহিনীর গুলিতে শ্রমিক মনু মিয়াসহ ১০ জনের মৃত্যুর খবরে বঙ্গবন্ধু উদ্বিগ্ন পড়ে পড়েন। দিনলিপির পাতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। অনেক রাত হয়ে গেল, ঘুম তো আসে না। নানা চিন্তা এসে পড়ে। এ এক মহাবিপদ, বই পড়ি, কাগজ উল্টাই, কিন্তু তাতে মন বসে না।…৬ দফার জন্য জেলে এসেছি, বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না।’
শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও কারাগারের ফটক থেকেই আবার সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসের ১০ নম্বর কক্ষে তাঁকে বন্দি রাখা হয়। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলার এক নম্বর আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে বাধ্য হয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দেন। এ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুকে যে কক্ষে রাখা হয়েছে তার দক্ষিণে ১৪ ফুট উঁচু দেয়াল, উত্তর দিকে ৪০ নম্বর সেল, যেখানে পাগলদের রাখা হয়েছে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একাকী বন্দি জীবনে অনেকের পক্ষে শারীরিক-মানসিক সুস্থতা অক্ষুণ্ন রাখা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘যতই কষ্টের ভিতর আমাকে রাখুক না কেন, দুঃখ আমি পাব না। এরা মনে করেছে বন্ধু শামসুল হককে (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) জেলে দিয়ে যেমন পাগল করে ফেলেছিল, আমাকেও একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।’
রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক রাজনীতি, পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক, ঋণ, সাহায্য ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। ভারতের কাশ্মীর নিয়ে যে সংকট চলছে তারও আলোকপাত দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর লেখায়। তিনি মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের জনগণের স্বার্থে কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতকে অধিক দায়ী করে মন্তব্য করেছেন : ‘ভারতের উচিত ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা শান্তিচুক্তি করে নেওয়া।’
স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে ঋণ সাহায্যের নামে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় বিস্তারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর মার্কিন সাহায্য নেওয়ার অসম্মানজনক প্রক্রিয়ায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে লিখেছেন : ‘নিজের দেশকে এত হেয় করে কোনো স্বাধীন দেশের সরকার এরূপভাবে সাহায্য গ্রহণ করতে পারে না। শুধু সরকারকে আপমান করে নাই, দেশের জনগণ ও দেশকেও অপমান করেছে। ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর স্নেহময়ী মা সায়েরা খাতুনকে কথা দিয়েছিলেন, ১৯৬৬ সালের ১৩ মে গ্রামের বাড়িতে খাবেন। কিন্তু ৮ মে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। এর মধ্যে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ব্যাকুল করে তোলে। মাতৃভূমির ডাকে ছয় দফার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জন্মদাত্রী মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি। সে কথা লিখেছেন মর্মস্পর্শী ভাষায়।
বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু মা-বাবা, পুত্র-কন্যার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর পরিবার, স্ত্রী-সন্তানরা তাঁর স্নেহ-পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দুই বছরের ছোট্ট শিশু রাসেল, মুখে বোল ফোটেনি, ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু বাবার স্নেহ বোঝে, বাবা যে বাড়িতে থাকে না, তা জানে। বাবার ভালোবাসা পেতে চায়, স্নেহের দাবিতে যখন বলে : ‘আব্বা বালি (বাড়ি) চল।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর আদরের সন্তানকে কী উত্তর দেবেন ভেবে পান না। তিনি লিখেছেন : ‘দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছার প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অকুণ্ঠ চিত্তে বেগম মুজিবের ধৈর্য, ত্যাগ ও অবদানের বিবরণ দিয়েছেন।বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে ও দুই মেয়ের কথা এসেছে এ গ্রন্থে নানাভাবে। বিশেষভাবে এসেছে জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার কথা। শেখ হাসিনার বিয়েতে প্রথমে বঙ্গবন্ধু সম্মত হননি। তিনি চেয়েছিলেন বিএ পাস করার পর মেয়ের বিয়ে দেবেন। তবে বেগম মুজিবের আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হন। কিন্তু কন্যাও বেঁকে বসেছিলেন দুটো কারণে। প্রথমত, তাঁর বাবা তখন কারাগারে বন্দি, দ্বিতীয়ত, বিয়ের আগে বিএ পাস করতে চান। শেষ পর্যন্ত মেয়ের সম্মতি আদায়ের দায় পড়ল বাবার ওপর, তিনি শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘মা আমি জেলে আছি, কতদিন থাকতে হবে, কিছুই ঠিক নাই। তবে মনে হয় সহজে আমাকে ছাড়বে না, কতগুলি মামলাও দিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হতে চলেছে। তোমাদের আবারও কষ্ট হবে। তোমার মা যাহা বলে শুনিও।’
বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীন চিন্তা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বলে মনে করতেন। যে কারণে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু শিক্ষকমণ্ডলী প্রতিবাদ না করায় হতাশ হয়ে লিখেছেন : ‘কলম ফেলে দিন। লাঠি, ছোরা চালানো শিখুন, আর কিছু তেল কিনুন, রাতে ও দিনে যখনই দরকার হবে নিয়ে হাজির হবেন। লেখাপড়ার দরকার নাই। প্রমোশন পাবেন, তারপরে মন্ত্রীও হতে পারবেন।’
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আলোকপাত করেছেন ‘কারাগারের রোচনামচা’ গ্রন্থে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্বের দিনলিপি এই গ্রন্থ। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার উত্তরণের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অমূল্য উৎস। বাঙালির জাগরণের দলিল হিসেবে গণ্য হবে গ্রন্থটি।
৩৩২ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। শিল্পী রাসেল কান্তি দাশ অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি অবলম্বনে গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও নকশা করেছেন তারিক সুজাত।
লেখক: সাংবাদিক ও সাবেকক ছাত্রনেতা;
তথ্যসূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা।