প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল যদি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম হতো! পুরো জনারণ্য পাঁচতারা হোটেল, ফুটবলের মানুষ উপচে পড়েছে এখানে ফুটবল নির্বাচন উপলক্ষে। এত মানুষ যদি ফুটবল ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে যেত, তাহলে ফুটবল আর দর্শকহীন থাকত না। বাফুফের নির্বাচনমুখর অবস্থা দেখে বারবার এটাই মনে হচ্ছে।
এই পাঁচতারা হোটেলের নিজস্ব প্রটোকল থাকলেও কাল যেন ফুটবলের মানুষের জোয়ারে সব ভেঙে পড়েছিল। পুরোটাই ছিল ফুটবলের লোকজনের দখলে। না, ফুটবলের লোক না বলে প্রার্থীদের নিজস্ব লোক বলাই শ্রেয়। এই দৃশ্য দেখে সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফফার আক্ষেপ করেছেন, ‘এই নির্বাচনে কত লোক, দেখেন। খেলা দেখতে এত লোক গেলে স্টেডিয়ামে জায়গা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। আমাদের সমস্যা হলো, খেলাটাকে গৌণ করে বাকি সবই মুখ্য হয়ে যায়। এসব কারণেই আমাদের ফুটবলের এই দুরবস্থা।’
চরিত্রগতভাবে এ দেশের মানুষ নিবার্চনমুখী, ব্যালটে হার-জিত দেখতেই তারা ভালোবাসে। প্রত্যেক প্রার্থীর পেছনে অনেক লোক, এভাবে অন্তত দুই হাজার লোকের হাওয়ায় তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবলের নির্বাচনী হাওয়া। কিন্তু তারা কি আসলে ফুটবলের উত্সাহী লোক নাকি নিতান্তই ভোটে উত্সাহী! নিজের প্রার্থীর জয় হলেই তারা ফুটবলের জয় ভাবে! আবার উল্টোটাও আছে। বাফুফের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন কাউন্সিলররা। সেই ভোটেই বড় ব্যবধানে জয়ী কাজী সালাউদ্দিন। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের বাইরে কিছু সংক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের হাতে সালাউদ্দিনবিরোধী ব্যানার!
দুর্ভাগা এই দেশ। এখানে ফুটবলের চেয়ে ভোটের হাওয়া বেশি। ফুটবলের ভালো-মন্দ পরে, আগে ভোট জেতা চাই। এ দেশের ফুটবল মানসিকতা এমনই! যেমন—এক ব্যবসায়ী সহসভাপতি প্রার্থী সোনারগাঁও হোটেলে চার-পাঁচটি কক্ষ নিয়ে দুই দিন ধরে জমিয়ে রাখলেও নির্বাচনের শেষ ফল নিয়ে বড় সন্দিহান। তাঁর পক্ষে যেন বেশি লোক ভোট চাইতে পারে, এ চেষ্টাতেই তিনি মরিয়া। দুই দিন ধরে কাউন্সিলররা সোনারগাঁও হোটেলে, নানা আয়োজনে তাঁদের মোহিত করার চেষ্টাও হয়েছে। ভোটের বিনিময়ে টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়েও উড়ো কথার ছড়াছড়ি। টাকা নিয়ে ভোট দেওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই এক ভোটার পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘বলতে পারেন, আমি টাকা নিয়ে ভোট দেব। কিন্তু আমি তো কোনো প্রার্থীর কাছে যাইনি, তারাই আমাকে খুঁজে নিয়ে ভোটের জন্য টাকার প্রস্তাব করেছে। তারা টাকা নিয়ে আমাদের কাছে না এলে তো আমরা টাকা নেওয়ার সুযোগ পেতাম না। তারা জানে, তারা ফুটবলের জন্য কোনো কাজ করেনি। তাই আমাদের কাছে টাকার প্রস্তাব করেছে। এভাবে চললে আমাদের ফুটবলের কোনো উন্নতি হবে না। কেন্দ্রীয়ভাবে ফুটবলের জন্য সালাউদ্দিন-সালামরাও কোনো কাজ করে না, তাই আমরাও জেলায় কাজ করি না।’
ফুটবলের উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকেই। তাদের পরিকল্পনাতেই রাখতে হবে জেলা ও বিভাগের ফুটবলকে, ঢাকার বাইরের ফুটবল উন্নয়ন না হলে দেশের ফুটবলের কোনো গতি হবে না। ঢাকার বাইরে থেকেই উঠে আসে ফুটবলাররা, তারাই সামগ্রিক ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু এই জেলা ও বিভাগের প্রতি বড় উদাসীন ছিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। ঢাকার ফুটবল, বিশেষ করে প্রিমিয়ার লিগ সচল রাখলেও নিচের লিগগুলো নিয়মিত করতে পারেননি। কিন্তু জেলা ও বিভাগের লিগ নিয়ে সেভাবে সিরিয়াস ছিলেন না সভাপতি। তাই ওখান থেকে ফুটবলারও উঠে আসেনি, এখন প্রিমিয়ার লিগের দল গড়তে গেলেই ক্লাবগুলো ফুটবলার সংকটে পড়ে। ঢাকার বাইরের ফুটবলটাই হতে পারে বাফুফের নতুন কাজের ক্ষেত্র, এখানে বিনিয়োগ করলে সামগ্রিক ফুটবল লাভবান হবে। তাই চট্টগ্রামের সংগঠক সিরাজ উদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর মনে করেন, ‘জেলার ফুটবলে নজর দিলে আর ভোটের সময় এত কিছু করতে হবে না। মানুষের হাতে-পায়ে ধরতে হবে না, ভোটাররা কাজের মূল্যায়ন করেই ভোট দিয়ে যাবে।’ এ রকম হলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও জাতীয় ফেডারেশনে রূপ নেবে। ভোট হয়ে যাবে গৌণ, মাঠের ফুটবলই তাদের হয়ে কথা বলছে। আগের চার বছরের কর্মকাণ্ডই বিশেষ গুরুত্ব পাবে।