অনলাইন ডেস্ক:ইসলামে ব্যভিচারকে অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কাজ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যভিচার ও ধর্ষণ রোধে ইসলাম পর্দার বিধান দিয়েছে, শালীন পোশাক পরিধানের কথা বলেছে। এবং নারী ও পুরুষকে চক্ষু অবনত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি ব্যভিচার ও ধর্ষণ রোধে ইসলামে পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে আমৃত্যু পাথর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শরিয়তে ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তার শাস্তি রজম বা পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ১০০ বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী—তাদের প্রত্যেককে ১০০ কশাঘাত করবে…।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২)
তবে এ শাস্তি প্রয়োগ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন। অন্যদিকে কোনো কারণে এ শাস্তি আরোপিত না হলে দুনিয়ায়ই কোনো না কোনোভাবে এর শাস্তি এসে যেতে পারে।
অপরাধ দূর করতে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা
অপরাধপ্রবণতা কমাতে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কথা বলে আধুনিক অপরাধবিজ্ঞান। রাসুলুল্লাহ (সা.) অপরাধপ্রবণতা দূর করতে এই পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি এমনভাবে অপরাধের স্বরূপ উন্মোচন করতেন যে মানুষের অপরাধস্পৃহা দূর হয়ে যেত। যেমন—এক যুবক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাইলে তিনি বলেন, তোমার মা, মেয়ে, বোন, ফুফি ও খালার সঙ্গে কেউ এমন করুক এটা কি তুমি পছন্দ করবে? সে বলল, না, এটা কেউ পছন্দ করবে না। রাসুল (সা.) তাকে বলেন, কোনো মানুষ তার আপনজনের সঙ্গে ব্যভিচার পছন্দ করে না। অতঃপর তিনি তার পাপমুক্তি ও আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য দোয়া করেন। (মুসনাদ আহমদ : ৫/২৫৬)
ধর্ষিতার করণীয়
ব্যভিচারের সমগোত্রীয় অথচ তার চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ হলো ধর্ষণ। ইসলামে ব্যভিচারের পাশাপাশি ধর্ষণও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ। দ্বিন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২; তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১)
ইসলামী আইনবিদরা এ মর্মে ঐকমত্যে রয়েছেন যে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)
ধর্ষকের শাস্তি
ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক পক্ষ থেকে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর অন্য পক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। শুধু জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সংঘটিত হয়। এক. ব্যভিচার। দুই. বল প্রয়োগ। তিন. সম্ভ্রম লুণ্ঠন। ব্যভিচারের জন্য কোরআনে বর্ণিত ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে।
হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব মতে, ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। তবে ইমাম মালেক (রহ.)-এর মতে, ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তির পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। ‘মুহারাবা’ হলো, অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করা। এককথায়, ‘মুহারাবা’ হলো পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, লুণ্ঠন, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ, ত্রাসের রাজ্য কায়েম করা ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ‘মুহারাবা’র শাস্তি এভাবে নির্ধারণ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে : তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে বা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটি তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩৩)
এ আয়াতের আলোকে মালেকি মাজহাবে ধর্ষণের শাস্তিতে ‘মুহারাবা’র শাস্তি যুক্ত করার মত দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, সমাজে ধর্ষণ মহামারির আকার ধারণ করলে, সমাজ থেকে ধর্ষণ সমূলে নির্মূল করার লক্ষ্যে এ শাস্তি প্রয়োগ করা জরুরি। (আল মুগনি : ৮/৯৮)
আর যদি ধর্ষণের সঙ্গে হত্যাজনিত অপরাধ যুক্ত হয়, তাহলে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
সব শেষে একটি বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি। সমাজ থেকে ব্যভিচার ও ধর্ষণ সমূলে নির্মূল শুধু দণ্ডবিধি ও আইনের কঠোরতার মাধ্যমে সম্ভব নাও হতে পারে। দণ্ডবিধি ব্যভিচার ও ধর্ষণ উপশমের একটি উপায়। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি, খোদাভীতি ও তাকওয়াভিত্তিক সমাজ।