চকচকে স্বর্ণের অলংকারে আমরা দেখি সৌন্দর্যের ছটা, সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কিন্তু এই ঝলকের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রতারণার অন্ধকার গল্প, যা সাধারণ মানুষ খুব একটা জানে না কিংবা জানতে চায় না। বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসা আজ এক গোপন অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে নেই কোনো কঠোর নিয়ম, নেই সরকারি মনিটরিং, নেই ভোক্তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা।
স্বর্ণের বাজারে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়, অথচ নেই কোনো নির্দিষ্ট মূল্য তালিকা বা সরকারি তদারকি। দুধে পানি মেশানো, মাপে কম দেওয়া কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি—এসব অপরাধের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের অভিযান আমরা দেখি নিয়মিত। কিন্তু স্বর্ণের দোকানে প্রতিদিন যে অগণিত প্রতারণা ঘটে, তা যেন আইনের চোখে অদৃশ্য।
দামের ওঠানামা আন্তর্জাতিক বাজারে হয় ঠিকই, কিন্তু স্থানীয় দোকানগুলোতে সেই পরিবর্তন কেমনভাবে প্রভাব ফেলে, তা জানার কোনো উপায় নেই। দোকানদার যা বলে, ক্রেতা তাই মেনে নেয়—এ যেন এক অব্যক্ত শাসনব্যবস্থা।
একজন ক্রেতা যখন গহনা কিনতে যায়, তখন দোকানদার বলে—“আজকের বাজারদর অনুযায়ী দাম।” কিন্তু সেই স্বর্ণ আসলেই কত ক্যারেট, তাতে কতখানি খাদ মেশানো, মজুরি কত—এসব জানতে চাইলেও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না।
ফলাফল, ক্রেতা যে দামে কিনছে, তাতে বিশুদ্ধ স্বর্ণের দাম আছে কি না, তা জানার উপায়ও থাকে না।
এভাবে বছরের পর বছর চলে আসছে অদৃশ্য এক প্রতারণা, যা সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে গৃহীত হয়ে গেছে।
গহনা তৈরির সময় বিশুদ্ধ স্বর্ণে মেশানো হয় তামা, দস্তা, রুপা ইত্যাদি ধাতু। এতে গহনার রং ও আকৃতি সুন্দর হয় ঠিকই, কিন্তু বিশুদ্ধতার হার কমে যায়। অথচ সেই খাদযুক্ত গহনাই বিক্রি হয় “২৪ ক্যারেট” দামের সমান মূল্যে!
অর্থাৎ ক্রেতা হয়তো ১০ ভরির গহনা কিনছেন, যার মধ্যে ৮ ভরি বিশুদ্ধ স্বর্ণ আর বাকি ২ ভরি ধাতু—কিন্তু দাম দিচ্ছেন পুরো ১০ ভরির।
গহনা বিক্রির সময় প্রতারণা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন দোকানদার বলে—
“এটা তো ২২ ক্যারেট, বিশুদ্ধ না।”
“খাদ আছে, দাম কম দিতে হবে।”
“কারিগরি খরচ বাদ দিতে হবে।”
ফলাফল, ৫০,০০০ টাকায় কেনা গহনার দাম এক সপ্তাহ পর হয়ে যায় ৪০,০০০ টাকারও কম। অথচ সেই একই গহনা আবার নতুন করে বিক্রি হয় অন্য ক্রেতার কাছে।
স্বর্ণ কেনার সময় নারীরা অনেক সময় আবেগে সিদ্ধান্ত নেন—বিনা দরকষাকষিতে বা যাচাই ছাড়াই। তাঁরা ভাবেন, অলংকার মানে সুখ, সৌন্দর্য ও সামাজিক মর্যাদা। কিন্তু এই আবেগকেই কাজে লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা।
নারীদের সচেতনতার অভাবই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতারণার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
এইসব সূক্ষ্ম প্রতারণার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে স্বর্ণকারদের বিলাসবহুল জীবন। প্রতিটি লেনদেনে লুকানো থাকে অজস্র মুনাফা—কখনো বিশুদ্ধতার নামে, কখনো কারিগরি খরচের নামে।
একজন সাধারণ ক্রেতা হয় ক্ষতির শিকার, আর স্বর্ণকার হয়ে ওঠে রাতারাতি ধনী।
এই অস্বচ্ছ ব্যবসা বন্ধে প্রয়োজন শক্ত পদক্ষেপ:
স্বর্ণের নির্ধারিত সরকারি রেট প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা।
প্রতিটি গহনার বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের সার্টিফিকেট (হালমার্কড জুয়েলারি) নিশ্চিত করা।
মজুরি ও খাদ পরিমাণ স্বচ্ছভাবে উল্লেখ করতে বাধ্য করা।
নারীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা—“দর করে, দেখে, বুঝে” কেনার অভ্যাস তৈরি করা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিয়মিত মনিটরিং চালু রাখা।
স্বর্ণ শুধু অলংকার নয়, একপ্রকার বিনিয়োগও বটে। কিন্তু অজ্ঞতা ও আবেগের ফাঁদে পড়ে সেই বিনিয়োগই অনেক সময় হয়ে ওঠে ক্ষতির কারণ।
তাই সময় এসেছে, স্বর্ণের ঝলক নয়—তার আড়ালের প্রতারণার প্রতিফলন বুঝে নেওয়ার।