আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীঃ
১৯৭৪ সালের কথা, আমি তখন কলকাতায়। স্ত্রী অসুস্থ। তার চিকিৎসা হচ্ছে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে পিজি হাসপাতালে (এখন নাম পাল্টে গেছে)। আমার দিন কাটে কখনও আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে, কখনও কলকাতার সাহিত্যিক বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় গিয়ে। তবে একবারও হাসপাতালে গিয়ে রুগ্ন স্ত্রীর পাশে বসে তাকে সময় দিতে ভুলিনি। আজ তিনি নেই।
তাকে স্মরণ করে সেদিনের কথাগুলো ভাবতে ভালো লাগে। তখন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তার বাড়িতেও মাঝে মাঝে যাই। তার স্ত্রী বিজয়াদি’র হাতের চা পান করি। সত্যজিৎ রায় এ সময় বাংলাদেশের কোনো লেখকের গল্প নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন। গল্প তিনি সিলেক্ট করেও ফেলেছিলেন। সেলিনা হোসেনের গল্প। সেলিনা হোসেন তখন একেবারেই নতুন লেখিকা। সত্যজিৎ রায়ের কাছে তো একেবারেই অচেনা-অজানা। তিনি আমাকেও সেলিনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমিও তখন সেলিনা হোসেনকে চিনি না। তবু সত্যজিৎ রায়কে কথা দিয়েছিলাম, আমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে সেলিনাকে খুঁজে বের করব এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেব। আমি এই যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। তবে সে প্রসঙ্গ থাক। সেটা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় ১৫ আগস্ট। এটা মুখবন্ধ।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হতেই আমি আরও অনেকের মতো তাকে মানিকদা ডাকতে শুরু করেছিলাম। তার অনুরোধেই নির্ভয়ে তার ছবির সমালোচনা করতাম। রাজনীতি বিষয়েও কদাচিৎ বিতর্ক হতো। মানুষটিকে আমার ভালোই লাগত। তার ব্যক্তিত্ব ছিল। একদিন তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু মানুষটি চরিত্রে এবং ব্যক্তিত্বে বিশাল। তিনি শুধু তোমাদের বঙ্গবন্ধু নন, আমাদেরও বঙ্গবন্ধু। এককালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যেমন ছিলেন সব বাঙালির বন্ধু, তেমনি বঙ্গবন্ধুও বিশ্বের সব বাঙালির বন্ধু।
আমি বললাম- মানিকদা, বঙ্গবন্ধু এখন আর শুধু সব বাঙালির বন্ধু নন, তিনি বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের বন্ধু বলে পরিচিত হয়েছেন। আখ্যা পেয়েছেন বিশ্ববন্ধু।
সত্যজিৎ রায় বললেন- আমরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং সর্বভারতীয় বাঙালিরা তাকে বন্ধু এবং নেতা হিসেবে পেতে চাই। কিন্তু তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেবল পূর্ববঙ্গে আটকে গেছে। জাতির অর্ধাংশ নিয়ে পূর্ণ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
আমি বললাম- বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, তখন বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছে সবার জন্যই তা জাতীয়তাবাদ। কিন্তু একদল রাজনীতিকের সাম্প্রদায়িক ও বিভেদমূলক রাজনীতির জন্য অবাস্তবভাবে দেশ ভাগ হয়েছে। বাঙালিরা ভাগ হয়ে গেছে। বর্তমানের এই রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আপাতত পূর্ব বাংলাকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করতে হয়েছে।
সত্যজিৎ রায় বলেন- তাহলে বঙ্গবন্ধু কি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ ভারতভুক্ত বাংলা ভাষাভাষী এলাকাগুলোকেও স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে চান?
বলেছি, জোর করেই কাউকে একটি দেশের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। বঙ্গবন্ধু তা চান না। পারবেনও না। বরং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের অবাঙালি শাসকদের একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব ও জাতীয়তার ঢেউ পশ্চিমবঙ্গতে লাগবে। এই ভয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খণ্ডিত করে একটি সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তারাই প্রচার করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ না হয়ে মুসলিম বাংলা হোক। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের নেতারাও চাচ্ছিলেন, বাংলাদেশ যেন শ্যাডো পাকিস্তান হয়। তাই বাংলাদেশের পাকিস্তানমনা ব্যক্তিরা কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী কর্তৃক প্রচারিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের থিয়োরিটা লুফে নিয়েছে।
সত্যজিৎ রায় বললেন- তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, বাংলার মূল অংশ বাদ দিয়ে কেবল একটি অংশে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
আমার মধ্যে অতো বড় বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটির সঙ্গে কেবল মানিকদা সম্বোধনের অধিকারে তর্ক করার প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে। বললাম, মানিকদা আদি বাংলার মূল অংশ আপনি কাকে বলছেন? পশ্চিমবঙ্গের নাম তো বঙ্গও ছিল না। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিম্পের যুগেও আদি বঙ্গ ছিল বর্তমানের বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গ দিল্লির আধিপত্য মেনে নিয়েছে, হিন্দি ভাষার কাছে বাংলা ভাষাকে নতিস্বীকার করিয়েছে। তখন পূর্ব বাংলা করাচি বা পিন্ডির দাসত্ব মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষা উর্দু ভাষার কাছে মাথা নত করেনি। আরও দেখুন, পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গ থেকে আলাদা হওয়ার পরও পূর্ববঙ্গের লোকেরাই পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন প্রফুল্ল সেন কি পূর্ববঙ্গের নন? রবীন্দ্রনাথের আদি পৈতৃক নিবাস কোথায়? আপনিও তো পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জের মানুষ। আপনাকে নিয়ে কি আমরা দুই বাংলার মানুষ গর্ব করি না?
সত্যজিৎ রায় আমার লম্বা বক্তৃতায় বিরক্ত হননি। কেবল হেসে বলেছিলেন, তুমি আমার আসল কথার জবাবও দাওনি। মূল বঙ্গ যেটাই হোক আমি বলছি, একটি দেশের খণ্ডাংশে সামগ্রিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অসাম্প্রদায়িক অখণ্ড জাতীয়তাবাদের একাংশ যাবে উত্তর ভারতের হিন্দি আধিপত্যের গ্রাসে। তোমাদের অংশ বর্তমানের ভাবাবেগের জোয়ার হ্রাস পেলেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদের কবলে আবার পড়বে। এবার ধর্মীয় জাতীয়তা আসবে আন্তর্জাকিতার ছাপ নিয়ে। খণ্ডিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ পারবে সেই অখণ্ড আন্তর্জাতিক ধর্মান্ধ জাতীয়তার মোকাবেলা করতে? এবার সে আর পাকিস্তান বা মুসলিম হোমল্যান্ডের রূপ ধরে আসবে না। আসবে ইসলামী বিশ্ব জাতীয়তার রূপ ধরে। বঙ্গবন্ধু তখন থাকবেন কি? সেই মহাপ্লাবন তোমরা একা রুখতে পারবে, না চাইবে?
সত্যজিৎ রায়ের কতটা ভবিষ্যৎ দৃষ্টি ছিল, তা তখন বুঝতে পারিনি। তাকে বলেছি, তাহলে ভবিষ্যতের এই মহাবিপদ কিভাবে রোখা যায় তা বলবেন কি?
সত্যজি রায় বললেন- ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানা খণ্ডিতই থাক, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাকে অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদে পরিণত করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে। এই ভাষার ভিত্তিতেই অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দু’জনেই ছিলেন বাঙালি রাজনৈতিক পুরুষ। তারা বাঙালিত্বের গণ্ডি ভেঙে সর্বভারতীয় নেতা হতে চেয়েছিলেন। উত্তর ভারতের গুজরাটি নেতৃত্ব তাদের দু’জনের নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। থ্যাঙ্কস গড, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু হয়েছেন, কিন্তু বাঙালিত্ব বর্জন করেননি। হয়তো তার আদর্শের ভিত্তিতেই একদিন অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তা গড়ে উঠবে।
একটু থেমে সত্যজিৎ রায় বললেন- আমি তোমাদের ববিতাকে কেন ‘অশনি সংকেত’ ছবির নায়িকা নির্বাচন করেছি? তার চেহারা ও বাচন-ভঙ্গির মধ্যে এখনও প্রকৃত বাঙালিত্ব রয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গের অনেক নায়ক-নায়িকার মধ্যে নেই। তারা হিন্দি বাচন-ভঙ্গিতে বাংলা বলতে চান। এরপর একদিন কলকাতা থেকে মুম্বাইতে বিমানযাত্রায় আকস্মিকভাবে সত্যজিৎ রায়ের সহযাত্রী হয়েছিলাম। সেদিনও তিনি আমাকে এই কথাটি বলেছিলেন।
ঢাকায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুকে সত্যজিৎ রায়ের খণ্ডিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বক্তব্য জানিয়েছিলাম। তিনি বললেন- ‘আমার সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সৈয়দ মুজতবা আলী আর ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার সন্তোষ কুমার ঘোষ দেখা করতে এসেছিলেন (আমিও এই সাক্ষাৎকারে ছিলাম)। তারাও খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি তুলেছিলেন। আমি তাদের বোঝাতে পেরেছি কি-না জানি না, বলেছি, দেখুন আলী সাহেব, আপনি তো আফগানিস্তানে বহুদিন ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস আপনি আমার থেকে ভালো জানেন। অটোম্যান এমপায়ারের ধ্বংসস্তূপের ওপর বহুবার ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মাথা তুলতে চেয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তার ধাক্কায় তা পারেনি। সৌদি আরবের ওহাবিজম এবং জামালুদ্দীন আফগানির প্যান ইসলামিক আন্দোলনের দাপটের কথা আপনি জানেন। সর্বশেষ মিসরের নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদ রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের ধর্মান্ধ জাতীয়তার থ্রেটের মুখে।
বঙ্গবন্ধু বললেন- আমি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের এবং বিশেষ করে খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের বিপদের কথা জানি। ফজলুল হক অখণ্ড বাংলায় বাংলাদেশভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি গঠন করেছিলেন। এমনকি জিন্নার মুসলিম লীগকে নির্বাচনে পরাজিতও করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত তৈরি করতে গিয়ে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির নেতা জিন্নাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আমি আপস বা আত্মসমর্পণে বিশ্বাসী নই। আমি আনন্দবাজারের সন্তোষ ঘোষকেও বলেছি, দেখুন সন্তোষ বাবু, আমি কোনো খণ্ডিত বাঙালি জাতীয়তার আদর্শের বীজ বপন করিনি। অখণ্ড জাতীয়তারই বীজ বপন করেছি একটি স্বাধীন অঞ্চলে। কিন্তু তার আবেদন ছড়ানো রয়েছে বিশ্বের সারা বাঙালির জন্য। বাঙালির একটাই পরিচয় হবে- তারা বাঙালি। রাজনৈতিক পরিচয় তাদের আলাদা হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু সন্তোষ ঘোষকে আরও বলেছেন- সন্তোষ বাবু, আপনারা ভয় পাবেন না। আমি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাকে এবং আসামের বৃহত্তর এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই না। তারা রাজনৈতিকভাবে ভারতের নাগরিক। কিন্তু ভাষাগতভাবে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সব বাঙালিকে নিয়েই এই জনগোষ্ঠী এবং তাদের সবার জন্য এই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ।
বঙ্গবন্ধু সৈয়দ মুজতবা আলীকে আবার আলী সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন এবং বলেছেন- আমি জানি সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা রণক্ষেত্রে পরাজিত করেছি, সমাজ-জীবনে পরাজিত করতে পরিনি। তারা আমাদের দুর্বল দেখলেই মাথা তুলবে। হয়তো ওরা ষড়যন্ত্র করে আমাকে হত্যা করবে। ইতিহাসের চাকা ঘোরাবে। কিন্তু পারবে না। আলী সাহেব, সন্তোষ বাবু, আমি যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বীজ রোপন করে গেলাম, তার মৃত্যু নেই। এই জাতীয়তাবাদের কোনো সীমান্ত বা সীমানা নেই। সারা বিশ্বের বাঙালি এই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হবে। নিজেদের রাজনৈতিক নাগরিক পরিচিয় তারা হারাবে না। কিন্তু বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে। তার ভিত্তি হবে ভাষা ও সংস্কৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার ভিত্তি করে সন্তোষ ঘোষ দীর্ঘ উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়।
মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম মৃত্যুদিবসে তাকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে পড়ছে তার ভবিষ্যদ্বাণী। বাংলাদেশে ধর্মান্ধদের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তাদের আবারও পরাজয় ঘটেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার পায়ের তলায় নতুন করে মাটি পাচ্ছে। তার জয় অবধারিত।
লন্ডন, ১৪ আগস্ট।