দেড় যুগ আগে ছিলেন পাবনা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী। পরিবারসহ থাকতেন একটি টিনশেড ঘরে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। পরে হন প্রতিমন্ত্রী। তারপরই ঘুরে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকা। প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য (এমপি) পদের প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য এবং নৌঘাট, হাটবাজার দখল শুরু করেন। এভাবে ১৬ বছরে তিনি ও তাঁর পরিবার শতকোটি টাকার মালিক বনে যায়। টিনশেড ঘরের স্থানে নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স ভবন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন দুই শতাধিক বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
নিয়োগ–বাণিজ্য ও জমি-ঘাট দখল করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিজের দলের যেসব নেতা-কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁদের ওপর হামলা চালাতেন। মামলা দিয়ে করতেন হয়রানি। বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরও মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এত সব অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও এমপি শামসুল হক (টুকু)। তিনি পাবনা-১ (বেড়া-সাঁথিয়া) আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। পরের তিনটি ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। তাঁর বড় ছেলে আসিফ শামস (রঞ্জন) ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নৌঘাটসহ বিভিন্ন হাট দখল করে টোল ও খাজনা আদায় করতেন বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
গত ১৪ আগস্ট রাতে শামসুল হক ঢাকা থেকে কলেজছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। ২০ দিন পুলিশি রিমান্ডে থাকার পর এখন তিনি জেলহাজতে। অন্যদিকে আসিফ শামস আত্মগোপনে রয়েছেন। কয়েক দিন আগে তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথমেই শামসুল হকের বেড়া পৌরসভার বৃশালিখা মহল্লায় ডুপ্লেক্স ভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। ভবন থেকে সবকিছু লুটপাট করার পর আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সীমানাপ্রাচীরের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। একই দিনে সাঁথিয়ায় অবস্থিত শামসুল হকের ছেলে আসিফ শামসের খামার থেকে শতাধিক গরু ও প্রায় ১৬টি পুকুরের মাছ লুট হয়। পরদিন বেড়া পৌর ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
শামসুল হক কারাগারে এবং তাঁর ছেলে আসিফ শামস আত্মগোপনে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০০৮ সালে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। এ সময় পাবনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ—এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকেরা; কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে শামসুল হককে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে শামসুল হক জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। তিনি প্রথমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বছর তিনেক আগে শামসুল হক তাঁর বড় ছেলে আসিফ শামসকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঢাকা থেকে বেড়ায় নিয়ে আসেন। সে সময় তিনি ঢাকায় ভিওআইপির ব্যবসা করতেন। বেড়ায় এসে আসিফ বাবার সহায়তায় বেড়া পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র হন। এরপর ‘বিতর্কিত’ একটি সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে শামসুল হক জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। তিনি প্রথমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বেড়ার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর আসিফ শামসের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই বাহিনী বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার হাটবাজার ও নৌঘাট দখল করে খাজনা ও টোল আদায় শুরু করে। যমুনা থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি শুরু করে। শামসুল হকের পরিবারের সদস্যরা বেড়া পৌর এলাকার পায়না ও বাড়াদিয়া মহল্লার অন্তত ২১০ বিঘা কৃষিজমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর পায়না মহল্লায় গিয়ে কথা হয় ২০–২৫ ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁরা জানান, ২০১২ সালের পর থেকে ওই এলাকায় পরিবারের সদস্যের নামে জমি কেনা শুরু করেন শামসুল হক। জমি কেনার সময় প্রচার করা হয়, সেখানে ‘সৌদিয়া অ্যাগ্রো সোলার পিভি পাওয়ার প্ল্যান্ট’ ও ‘লুৎফুন্নেছা ইউনিভার্সিটি অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এভাবে দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৯০ বিঘা জমি কেনেন তাঁরা। পাশাপাশি ২১০ বিঘা জমি দখল করেন। ২০১৮ সালের পর হঠাৎ তাঁরা ওই জমিতে বালু ফেলা শুরু করেন।
সূত্র-প্রথম আলো