নিজেদের রাজনৈতিক পথের কাঁটা সরাতে পহেলা আগস্ট রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। একই দিনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনও জারি করে। জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার চারদিন পর ৫ আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের একদফা দাবিতে তুমুল আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। এর পরই সারা দেশে কোনো রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে মাঠে নামে জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবির। পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ও দীর্ঘদিন পর রাজপথে প্রকাশ্যে এসে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে দেখা যায় দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের।
যদিও তারা বলেছেন, তাদের দলীয় কার্যক্রম সব সময়ই অব্যাহত ছিলো, শুধুমাত্র সরকারের দেওয়া মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে কিছুটা আড়ালে আবডালে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়ে ছিলো। তখন তাদের মনে পুলিশি ভয় ছিলো খুব বেশি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব বেড়েছে জামায়াতের। এখন রাজপথে সক্রিয় থাকার উপযুক্ত সময়। প্রতিশোধ পারায়ণ না হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনীতি করতে চায় জামায়াতে ইসলাম।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই চাঙাভাব ফিরে এসেছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির দলীয় নেতা কর্মীদের মাঝে। তারা মনে করছেন, শেখ হাসিনা ছিলেন চরম রকমের স্বৈরাচারী মনোভাব সম্পন্ন একজন মহিলা। তার অবসানের মধ্য দিয়ে দমন-পীড়ন, গুম, খুন ও আয়নাঘরের রাজনীতির অবসান হয়েছে। এতোদিন সাধারণ মানুষের কোনো বাক স্বাধীনতা ছিলো না। দীর্ঘদিন পর মানুষ তাদের কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছেন। অনেকটা সময় পরে হলেও মানুষ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন বলে মনে করছেন ভাঙ্গুড়ার বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা।
৫ আগস্ট সোমবার থেকে জামায়াতে ইসলামের স্থানীয় কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা সহজেই অনুমান করা যায়। আওয়ামী লীগ পতনের দিন বিকাল সাড়ে ৩টায় উপজেলার শরৎনগর বাজারে তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল করে দলটি। পরে ভাঙ্গুড়া বাজারে বিএনপি-জনতার আনন্দ মিছিলে শরিক হন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় শরৎনগর বাজার ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কাতারবন্দি হয়ে শোকরানা স্বরূপ সিজদা আদায় করেন তারা। আছরের নামাজের পর শরৎনগর বাজারে আরো একটি আনন্দ মিছিল করে দলটি।
পরদিন মঙ্গলবার আবারও শরৎনগর বাজারে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দলটি। উপজেলা জুড়ে মিষ্টান্ন বিতরণ ও বাজারে বাজারে শোকরানা মিছিল করেন তারা। বুধবারও সক্রিয় ছিলো দীর্ঘদিন আড়ালে থেকে রাজনীতি করা এই দলটি। এদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তারা। এসময় দায়িত্ব পালনে সকলকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পরে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মন্দির পরিদর্শন করে হিন্দু নেতাদের সাথে কথা বলেন তারা। এসময় মন্দির ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় সব ধরনের আশ্বাস প্রদান করেন নেতারা। বুধবার (১৪ আগস্ট) সহিংসতা বন্ধে ও সম্প্রীতি রক্ষায় শরৎনগর বাজার ও বাসস্ট্যান্ড বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা।
বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আচরণে তারা অতিষ্ঠ ছিলেন। পুলিশকে তাদের পেটোয়া বাহিনী বানিয়ে রেখেছিলো সরকার। আইনগৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণ করে গুম, খুন ও ভোট বিহীন রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার হাত ধরে শেখ হাসিনার পতন ও দেশ ত্যাগের ঘটনায় দেশের মানুষ বাক স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন। সর্বশেষ ১৪ ও ১৫ আগস্ট শরৎনগর বাজার ও বাসস্ট্যান্ডে পৃথক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মজিবুর রহমান, সাবেক আহ্বায়ক রাজিবুল হোসেন বাবু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সদস্য সচিব এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নূর মুজাহিদ স্বপন।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মো: রাজিউল হাসান বাবু চলনবিলের আলোকে বলেন, হাসিনা সরকার দেশকে একটি কারাগার করে রেখেছিলো। আমরা যারা ভিন্ন মতের মানুষ তাদেরকে দমন-পীড়ন করাই ছিলো স্বৈরাচারী হাসিনার প্রধান কাজ। ক্ষমতার অপব্যবহার কাকে বলে তা দেখিয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ অবমুক্ত হয়েছেন। বাক স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন। দীর্ঘদিন পর মুক্তমনে রাজপথে ফিরতে পেরে খুব খুশি নেতাকর্মীরা। এখন অন্তর্বতীকালীন সরকারের মাধ্যমে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে আসবে বলে আমাদের ধারণা। আমরাও সেই অনুপাতে কাজ করে যাচ্ছি। তাই আমরা উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে রাজপথে নেমেছি। আমাদের সুদিন আসবে ইনশাল্লাহ। বিএনপিতে থেকে যারা আওয়ামী লীগের সাথে আতাত করে রাজনীতি করেছেন তাদের থেকে সাবধান থাকার আহ্বান করেছেন তিনি।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামের সাবেক আমির ও জেলা জামায়াতে তারবিয়াত বিভাগের সহ-সেক্রেটারি অধ্যাপক মাওলানা: আলী আছগার চলনবিলের আলোকে বলেন, জামায়াত কিংবা শিবির কখনোই শেষ হয়ে যায়নি, এটি শেষ হওয়ার মতো দল নয়। শেখ হাসিনা সরকারের দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, পুলিশি হয়রানীসহ সব ধরনের নির্যাতন করে আমাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছিলো। প্রকাশ্যে না হলেও আমরা আমাদের সবকয়টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। জেল-জুলুম নির্যাতন শিকার করে আমাদের নেতাকর্মীরা জামায়াতের আদর্শ ছেড়ে যাননি। এজন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া। সরকার আমাদের সাথে যা করেছিলো তা মোটেও যুক্তিযুক্ত ছিলো না। ছাত্রদের ক্ষোভ আমাদের উপর ঝেড়ে আমাদের দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের দলকে নিষিদ্ধ করা জনদাবি ছিলো না, রাষ্ট্রীয় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গত কয়েকদিনে ওসি, ইউএনও এবং হিন্দু ধর্মের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাথে কথা বলেছি। তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছি। অচিরেই ভাঙ্গুড়ায় একটি দলীয় কার্যালয় করা হবে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল দলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করে যেতে চায় জামায়াতে ইসলাম।