মিলাদুন্নবী অর্থ নবীর জন্ম। ঈদে মিলাদন্নবী অর্থ নবীর আগমন উপলক্ষে খুশি উদ্যাপন করা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর শুভাগমনকে উপলক্ষ করে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, হামদ-নাত-কাসীদা-দরূদ পাঠ, তাঁর আগমন দিবসের অলৌকিক ঘটনাবলীর আলোচনা, তাঁর আদর্শ-চরিত্র ও জীবনী বর্ণনার মাহফিল, আনন্দ মিছিল, দান-খয়রাত, আপ্যায়ন, রোযা রাখা ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করার মাধ্যমে খুশি উদ্যাপন করাকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হয়। আভিধানিক অর্থে মিলাদ অর্থ জন্ম হলেও রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর ক্ষেত্রে শব্দটি আগমন অর্থে ব্যবহার করা অধিক যুক্তিপূর্ণ। কারণ, আল-কুরআনের যেখানেই তাঁর আগমনের কথা উল্লেখ হয়েছে সেখানেই মাজিয়্যাত (আসা) বি‘ছাত (প্রেরণ) ইরসাল (প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা) ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার হয়েছে। এ দিক থেকে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ ‘নবীর জন্মোৎসব’ না করে ‘নবী আগমনের খুশি’ করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তাঁর আগমনের বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার নিকট অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তিনি আত্মার জগতে নবীগণ (আ.)-এর সমাবেশে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। আসমানি কিতাবসমূহে তাঁর আগমন বিষয়ক ও প্রশংসাসূচক আয়াত সন্নিবেশিত ছিল।
পূর্ববতী প্রত্যেক নবী-রাসূল (আ.) স্ব স্ব উম্মতের নিকট তাঁর আগমনের কথা পৌঁছিয়েছেন। তিনি নিজেও আর্থিক ও শারীরিক ইবাদতের মাধ্যমে নিজের আগমন দিবস পালন করেছেন। যুগে যুগে স্ব স্ব পরিসরে মুসলমানরা এ দিবস পালন করে আসছেন এবং এ উপলক্ষে শরীয়তসম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করে আসছেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর আগমন হয়েছিল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার। তাঁর জন্মের চেয়ে আগমনের বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাপক অর্থবোধক হওয়ার কারণে এবং তাঁর আগমন কিয়ামত অবধি সব ব্যক্তি, স্থান ও কালের জন্য প্রযোজ্য বিধায় মিলাদুন্নবীর কর্মসূচিকে উক্ত দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছর পালন করাই হলো তাঁর আগমনী আনন্দের দাবি। এ আনন্দ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য হলো তাঁর জাতের প্রতি এবং তাঁর আনীত যাবতীয় বিধি-বিধানের প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ ও সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং বাস্তব জীবনে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়ার সাধনা করা। এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবীর দর্শনকে গ্রহণ করলে যথাযথ খুশি উদ্যাপন করা হবে নিঃসন্দেহে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আপনি বলে দিন, আল্লাহর ফজল (অনুগ্রহ) এবং রহমত (দয়া) এর বিনিময়ে তারা যেন আনন্দ করে। এটি তাদের অর্জিত সব সঞ্চয় হতে উত্তম” (সূরা ইউনুস: ৫৮)। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া প্রাপ্তির ওপর খুশি উদ্যাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এমন কাজকে উত্তম ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে ‘ফজল’ ও ‘রহমত’ দু’টি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। এ দু’টি শব্দ আল-কুরআনের কয়েক স্থানে এসেছে। যেমন বলা হয়েছে, “যদি আল্লাহর ফজল ও রহমত তোমাদের ওপর না হতো, তাহলে তোমাদের মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে” (সূরা নিসা: ৮৩)। আরবি ব্যাকরণ ও তাফসীর বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী এখানে ‘ফজল’ ও ‘রহমত’ দ্বারা একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বুঝানো অধিক যুক্তি সঙ্গত। আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)। যদি ‘ফজল’ ও ‘রহমত’ দ্বারা স্বতন্ত্র অর্থ নেয়া হয় তখনও শব্দদ্বয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছেন তিনি। কেননা, সূরা আম্বিয়া-এর ১০৭ নম্বর আয়াতে তাঁকে ‘রহমত’ এবং সূরা জুমুয়া‘র ৪র্থ আয়াতে ‘ফজল’ বলা হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ‘মিলাদুন্নবী’ কিতাবে বলেন, “ফজল ও রহমতের মূল হচ্ছে প্রিয় নবী (দ.)-এর পবিত্র সত্ত্বা। অতএব এ মহান জাতের আগমনের ওপর যতই আনন্দ করা হোক না কেন, তা কমই হবে।”
এছাড়া পবিত্র কুরআনের দুু‘টি আয়াতে সরাসরি মিলাদ দিবসে সালাম পাঠের কথা উল্লেখ হয়েছে। যথা, এক. “তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, যে দিন সে জন্মগ্রহণ করে, যে দিন সে মৃত্যুবরণ করে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে” (সূরা মরইয়ম: ১৫)। দুই. “আমার জন্মদিনে আমার ওপর সালাম বর্ষিত হোক, সালাম বর্ষিত হোক যে দিন আমি মৃত্যু বরণ করবো আর সালাম বর্ষিত হোক, যে দিন আমি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবো” (প্রাগুক্ত: ৩৩)। উক্ত দু’টি আয়াতে দু’জন নবীর জন্ম, মৃত্যু ও পুনরুত্থান দিবসে তাঁদের ওপর সালাম পেশ করার কথা এসেছে। প্রথম আয়াতে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এর প্রতি সালাম পেশ করেছেন আল্লাহ তায়ালা নিজেই। দ্বিতীয় আয়াতে হযরত ঈসা (আ.) নিজের জন্মদিনে নিজের প্রতি সালাম পেশ করেছেন; যা আল্লাহ তায়ালার ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের অন্যতম কর্মসূচি হলো আল্লার নবীর (দ.) ওপর ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে দরূদ-সালাম পাঠ করা। সুতরাং জন্মদিবসে সালাম পাঠ করা যেমন আল্লাহর সুন্নাত, তেমনি নবীর সুন্নাত। আয়াতদ্বয় থেকে এটাও প্রমাণিত যে, তাঁদের মৃত্যুদিবসেও ছালাত-সালাম পেশ করার বিধান একই। উক্ত আয়াতদ্বয়ের বাচনভঙ্গি থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে, জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস ও পুনরুত্থান দিবসের আলোচনা আল-কুরআনে অনুমোদিত। এমনকি উম্মতের যে কারো মৃত্যুতে নবী (দ.)-এর ওপর দরূদ সালাম পেশ করাও শরীয়তসম্মত। যেমন জানাযার নামাযের নিয়ত ও বিধানের মধ্যে দরূদ-সালাম পেশ করার বিধান রয়েছে। সুতরাং জন্মদিবস উদ্যাপন এবং এই উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ইত্যাদির মত নেক আমল ও কর্মসূচি পালন করা বিদয়াত বলার অবকাশ নেই। উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের অর্থালোকে “সুনির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ১২ রবিউল আওয়াল মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করার কোন দিক-নির্দেশনা আল-কুরআনে নেই” এমন দাবি রহিত হয়ে যায়।
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা প্রথমে মানুষের আত্মা সৃষ্টি করেছেন। আত্মার জগতের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল মিলাদুন্নবী তথা নবী (দ.)-এর আগমন। আল্লাহ তায়ালা সে জগতে নবীগণ (আ.)-কে জমায়েত করে শেষ নবীর গুণ-কীর্তন পূর্বক তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করার জন্য তাঁদের থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন।
উক্ত ঘটনা স্মরণ করার জন্য তিনি মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন বলা হয়েছে, “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীগণের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আমি কিতাব ও হিকমত যা কিছু তোমাদেরকে দান করেছি, এরপর যদি তোমাদের নিকট এমন রাসূল আগমন করেন; যিনি তোমাদের কিতাবকে সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা সে রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে” (সূরা আলে ইমরান: ৮৯)। এভাবে আল-কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিয়ামতের স্মরণ এবং এর শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হচ্ছেন রাসূল (দ.)। যেমন বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের প্রতি (প্রেরিত) আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতপর তিনি তোমাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিলেন এবং তোমরা তাঁর নিয়ামতের মাধ্যমে পরস্পর ভাই হয়ে গেলে” (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)। ইমাম ইবন কাছীর কর্তৃক বর্ণিত উক্ত আয়াতের শানে নুযুল দ্বারা সুপ্রমাণিত হয় যে, এখানে নিয়ামত বলতে রাসূল (দ.)-কে বুঝানো হয়েছে। সূরা ইব্রাহীমের ২৭ নম্বর আয়াতের ‘নিয়ামত’ শব্দ দ্বারাও তাঁকে বুঝানো হয়েছে মর্মে হযরত ইবন আব্বাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (দ.) নিজে কায়িক ও আর্থিক ইবাদত দ্বারা তাঁর আগমন দিবস পালন করেছেন।
প্রতি সোমবার রোযা পালনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যেহেতু এ দিন আমার জন্ম হয়েছে এবং আমার ওপর কিতাব নাযিল হয়েছে” (ছহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৮০৭)। তিনি মদিনা জীবনে বকরি জবেহ করে ফকির-মিসকিনদের মাঝে তা বন্টন করে দিয়ে নিজের আগমন দিবস পালন করেছেন। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি তাঁর ‘আল-হাভী’ কিতাবের মিলাদ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। কেউ হয়ত মনে করতে পারে যে, তিনি নিজের আকিকা দেয়ার জন্য সেটি করেছেন। তাই ইমাম সুয়ূতি বলেন, “আকিকা দু’বার করা হয় না (তাঁর আকিকা তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব করেছিলেন)।
সুতরাং তাঁর বকরি জবেহ করা ছিল এ জন্য যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সমগ্র জগতের জন্য রহমত করে পাঠিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি এ কাজকে তাঁর উম্মতের জন্য বিধিত করে দিয়েছেন। যেমন তিনি নিজের ওপর দরূদ পড়তেন। অতএব আমাদের জন্য মুস্তাহাব হলো যে, আমরা যেন তাঁর মিলাদের শুকরিয়া করি।” প্রখ্যাত সমালোচক মুহাদ্দিস ইবন জুজি ‘আল-মিলাদুন্নববী’ কিতাবে বলেন, “মক্কা, মদিনা, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ আরব জাহানের সব মুসলমানগণ নবী আগমনের মাহফিল আয়োজন করে আসছেন। তাঁরা রবিউল আউয়াল মাসে আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। এ উপলক্ষে নবীর ওপর দরূদ পাঠ করা ও শুনাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তাঁরা এ সমুদয় কর্মসূচির মাধ্যমে উত্তম প্রতিদান ও বড় সফলতা লাভ করে আসছেন।” সুতরাং যাঁর আগমনের কারণে মানুষ এক আল্লাহর সন্ধান পেয়েছে, অন্ধকারের অমানিশা থেকে মুক্তি পেয়েছে, সত্যিকার স্বাধিনতা পেয়েছে, নারীরা প্রকৃত মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার পেয়েছে, প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার মানুষ নিজেদের স্ব স্ব মর্যাদা ও অধিকার পেয়েছে, সর্বোপরি মানবতার বিজয় সূচিত হয়েছে, সে মহান জাতের আগমন দিবসটি কি সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন হবে না?