সিরাজগঞ্জ শহীদ এম.মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে। রোগীদের উন্নত চিকিৎসায় ব্যবহৃত ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) নামের মেশিনটি কিনতে সরকারী টাকা ১৮ কোটি টাকা আগাম পরিশোধের পর ১৪ মাসে মেলেনি যন্ত্রটি। ঠিকাদার মাহফুজ হুদা সৈকত মালিকাধীন ‘গ্রীনট্রেড’কে বিধি-বহির্ভুতভাবে আগাম দেয়ার পর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মালিক টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হিসাব রক্ষন অফিসের চেকের মাধ্যমে গত বছরের জুনে ওই টাকা হাতিয়ে চম্পট দেন ঠিকাদার সৈকত। এছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীন প্রধান হিসাব নিয়ন্ত্রক শাখার যোগসাজসে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সরকারী বরাদ্দের আরো প্রায় পচিঁশ কোটি টাকা লোপাট করা হয় ‘সমন্বিত বাজেট ও হিসেব সংরক্ষন ব্যবস্থা’ থেকে। অন্যদিকে হাসপাতালের বহু টাকা মুল্যের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় নষ্ট হয়ে পড়েছে। এমনকি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষনের টাকাও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে চিকিৎসেবা নিতে আসা রোগী ও সিরাজগঞ্জবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। অভিযোগ ওঠেছে, সিরাজগঞ্জ শহীদ এম.মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওই যন্ত্র কেনা সহ সকল অনিয়মে ঠিকাদার মাহফুজকে অনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছেন পিডি ডা: কৃষ্ণ কুমার পাল।
জানা যায়, ২০১৫ সালে ৮৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ দশমিক ৯০ একর জমির উপর সিরাজগঞ্জ শহরের পাশেই শিয়ালকোল এলাকয় শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ এবং ৫শ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হয়। ২০২১ সালের ২ আগষ্ট ঢাকা থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালিক নব-নির্মিত ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরুর আগেই বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা উদ্বোধন করেন। এরই মধ্যে চিকিৎসা সেবার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৮ কোটি টাকার মুল্যের ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হলেও ১৪ মাসে মেলেনি মেশিনটি। যন্ত্র সরবরাহ তো দুরের কথা, চৌদ্দ মাসেও ঠিকাদার মাহফুজকে খুঁজে পায়নি কেউই। না পেয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগ বা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়। পায়নি হিসেব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ) কার্যালয়। এমনকি দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও। গত চৌদ্দ মাসে বিভিন্ন দপ্তর থেকে দফায় দফায় তদন্ত হলেও কোনটির মুখোমুখি হননি ঠিকাদার মাহফুজ সৈকত। যে কারনে কোন তদন্তের আলোর মুখ দেখেনি এখনও। এবারও অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এদিকে, ভুয়া বিল-ভাউচার ও ‘কোড’ পরিবর্তন করে ‘নির্মাণ খাতের ‘সমন্বিত বাজেট ও হিসেব সংরক্ষন ব্যবস্থা’ আইবাস হিসেব থেকে পচিঁশ কোটি টাকা ঢাকার এম.জাহান ট্রেডার্সের মালিক মহসিন আলী ও গ্রীন ট্রেডের মাহফুজ হুদা সৈকত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে গত বছরের জুন মাসে। অর্থলোপাটের হোতা মহসিন-মাহফুজ লাপাত্তা হলেও হিসেব নিয়ন্ত্রক শাখার কর্মকর্তা আফজাল-উল-বাশার, তৈয়বা আকতার (নীরিক্ষক)সিফাত-আরা-সাফিনা, অধীক্ষক সুরাইয়া আকতার ও মোহাম্মদ মহসিন মিজি সাময়িক বরখাস্ত হন। ঠিকাদারের পক্ষে চেক গ্রহনকারী ঢাকার তেজঁগাও স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চমান সহকারী আনিসুর রহমানও ইতোমধ্যে দুদকের জালে ধরা পড়েছেন।
দুদক সমন্বিত কার্যালয়, ঢাকা-১’র উপ-পরিচালক এম.আকতার হামিদ ভুইয়া বলেন, ঘটনার মাস্টার মাইন্ড মহসিন আলী ও মাহফুজ হুদা সৈকত লাপাত্তা হলেও তাদের একান্ত সহকারী আনিছুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলারটির তদন্ত চলছে।
অন্যদিকে, একই এতিষ্ঠানের প্রায় একশ পঁচিশ কোটি টাকার ডাক্তারী যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় বিশ কোটি টাকা পাচারের দায়ে মানি লন্ডারিং আইনে গত ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর পৃথক আরেকটি মামলা করে দুদক। আসবাবপত্রের বেশীরভাগই অসাড়ি ও নিম্মমানের কাঠ দিয়ে তেরী। যে কারনে পিডি ডা: কৃষ্ণ কুমার পাল ও বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিকাল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জাহের উদ্দিন সরকারের নামে পাবনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়।
হাসপাতালের ডা. এইচ মুরাল জানান, ইউএসতে দুজন ডাক্তারকে প্রশিক্ষনের পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু পাঠানো হয়নি। শুনেছি প্রশিক্ষনের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের ডা. আমিনুল ইসলাম খান জানান, হাপসাতাল চালুর আগে অনেক যন্ত্রপাতি কেনায় নাক-গলার অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, যন্ত্রপাতির সংকট থাকলেও বিনা অপারেশনে যুবকের পেট থেকে ২৩টি কলম বের করা হয়েছিল। যা বাংলাদেশে প্রথম। যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত দুর্নীতি দুর করা গেলে মানুষকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে।
পিডি কৃষ্ণ কুমার পাল ডিডিপি অনুযায়ী কাজ হয়েছে দাবী করে জানান, আইবাস থেকে ২৫ কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় দুদক মামলা করেছে। পৌনে তিন বছর আগে আরেকটি পৃথক ঘটনায় দুদকও তদন্ত করছে। এমআরআই মেশিন ক্রয়ে আগাম বিল পরিশোধ করা হলেও নিরাপত্তা জামানত হিসেবে চোদ্দ কোটি টাকার পেমেন্ট অর্ডার রাখা হয়েছে। কিন্তু, বর্তমান জটিলতায় ব্যাংক থেকে সেটি ক্যাশ করা সম্ভব হচ্ছেনা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ও এটি জানে। আমরাও এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থাও নিয়েছি। টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ সায়ফুল ফেরদৌস মুহা: খায়রুল আতাতুর্ক জানান, এমআরআই যন্ত্র এখনও পাওয়া যায়নি। দুদক বিষয়টি তদন্ত করছে। যন্ত্রটি সিরাজগঞ্জ না আসায় উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তিতে বঞ্ছিত হচ্ছেন দুর-দুরান্তের সেবা প্রত্যাশী রোগীরা।