সরকার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত অসহায় নারীদের প্রশিক্ষণের পর আত্মনির্ভরশীল করতে শুধুমাত্র ৫ ভাগ সার্ভিসচার্জে কোটি কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিলেও সুজানগর উপজেলায় নারীরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মহিলা অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৮৩ অসহায় মহিলার নামে ঋণ দেখিয়ে প্রায় ১৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। পরিস্থিতির শিকার মহিলাদের অজানা আশঙ্কায় দিন কাটাতে হচ্ছে।এসব দু:স্থ মহিলা ঋণ আত্মসাতের তদন্তসহ দায়ি কর্মকর্তা কর্মচারির বিচার দাবি করেছেন।
মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করতে মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সুজানগরে ফুড প্রসেসিং ও ফ্যাশন ডিজাইন ট্রেড কোর্সে প্রশি¶ণ দেয়া হয়। এ ট্রেডে অংশ নেয়া মহিলারা সরকারি নিয়মে ঋণ পেতে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো: আফজাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করলে তাদের আইডি কার্ডের কপি ও ছবি জমা দিতে বলা হয়। তারা জমা দিয়ে দিনের পর দিন অফিসে ধর্ণা দিলেও তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন এ মহিলাদের জমা দেয়া আইডি কার্ড ও ছবি ব্যবহার করে তাদের নামে ঋণ দেখিয়ে তা আত্মনাত করেন। ওই মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অবসর ছুটিতে) ১৮তম ব্যাচে ৬০ জন দু:স্থ মহিলার প্রত্যেকের নামে ১৫ হাজার করে ঋণ দেখিয়ে ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাচে ৬০ জনকে ঋণ বিতরণ দেখানো হলেও শুধুমাত্র সুজানগরের ভবানীপুর গ্রামের মো: খলিলুর রহমানের মেয়ে খালেদা ফেরদৌস আসমাকে ঋণের টাকা দেয়া বাকি ৫৯ জনের নামে টাকা তুলে আত্মসাত করা হয়েছে ।
ঋণের এ তালিকা অনুসন্ধানে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নারুহাটির মো: আমজাদ আলী মন্ডলের কন্যা মোছা. তাসলিমা খাতুন, তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের রামজীবন পুরের মো: আলমগীর হোসেনের মেয়ে আফরোজা আক্তার, চরভবানীপুর গ্রামের মো. মকবুল হোসেনের মেয়ে শিরিন আক্তার,ভবানীপুর প্রফেসর পাড়ার নারায়ন চন্দ বিশ^াসের মেয়ে নমিতা রানী বিশ্বাস, একই পাড়ার মো. ইদ্রিস আলীর মেয়ে পারুল আক্তার, ভবানীপুর পশ্চিমপাড়ার মো. কেয়ামত মোল্লার মেয়ে মোছা.মুন্নি খাতুন, একই পাড়ার মো. রমজান আলীর মেয়ে মোছা সুষমা আক্তার,ভবানীপুর পুর্বপাড়ার মো. ফিরোজ বিশ্বাসের কন্যা আফছানা
মিমি,ভবানীপুরের রফিকুল ইসলামের কন্য রাবেয়া সুলতানা, ভবানীপুর উত্তব পাড়ার মো. কেরামত আলীর মেয়ে মুর্শিদা খাতুন ভবানীপুরের আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে তাসলিমা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগে জানতে চাইলে তাদের অধিকাংশই পাল্টা প্রশ্ন করেন আমরা ঋণ নিয়েছি আপনাকে কে বললো ? অধিকাংশ মহিলার দাবি তারা ঋণের জন্য গেলে আফজাল হোসেন স্যার তাদের ছবি ও আইডি কার্ডের কপি জমা দিতে বলেন । এরপর তাদের বছরের পর বছর ঘুরানোর পর বলা হয় এখন টাকা দেয়া যাবে না আর এখন শুনছি আমাদের নামে ঋণ তুলে নেয়া হয়েছে। তবে কয়েক জনের অভিযোগ এনজিওতে চাকরির কথা বলে তাদেরকে আইডি কার্ড ও ছবি জমা দিতে বলা হয়।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন একই কায়দায় ১৭তম ব্যাচের ১২ মহিলার নামে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে আত্মসাত করেন। এ তালিকায় সাতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ফকিৎপুরের ৬ মহিলার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। ফকিৎপুরের শহীদুল ইসলামের ন্ত্রী মোছা. বৃষ্টি খাতুন,আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী হাওয়া খাতুন, মো. আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী মোছা. রোজিনা খাতুন, আব্দুল মজিদের স্ত্রী ছাবেদা খাতুন, মো. হোসেন প্রাং স্ত্রী মোছা. হাসিনা খাতুন, মো. বাচা মন্ডলের স্ত্রী মোছা. লাবনী খাতুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান তাদের ঋণ দেয়া হয়নি। ঋণ তালিকায় থাকা ভবানীপুর পশ্চিম পাড়ার আনিছুর রহমানের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন, নিশ্চিন্তপুরে আনছার আলীর স্ত্রী মোছা.শেফালী খাতুন, মাসুন্দিয়া গ্রামের মো. রজব আলীর স্ত্রী রাবি খাতুন, খয়রান গ্রামের মো. হাতেম আলীর স্ত্রী মোছা, আম্বিয়া খাতুন, তারাবাড়ীয়া গ্রামের মো. আতিকুল ইসলামের স্ত্রী মোছা. অনিকা আক্তার বৃষ্টি ও একই গ্রামের সো. শফি মন্ডলের স্ত্রী আসমা খাতুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও কোন ঋণ পাননি বলে জানান। তালিকার প্রথম দুজনকে ১০ হাজার অন্যদের ১৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেখানো হয়েছে।
শুধু ঋণের টাকাই জালিয়াতি করা হয়নি সরকারের মা শিশু সহায়তা কর্মসূচির ১৫-১৬ লাখ টাকা জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে তুলে আত্মসাতের ঘটনা ও অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে।সরকার মা শিশু সহায়তা কর্মসুচির আওতায় গর্ভবতি মহিলাদের প্রতিমাসে ৮০০ টাকা করে প্রথমে ২ বছর দেয়ার পর ১ বছর বাড়ানোসহ ভাতা দ্বিগুন করে। ্ ২০২১ সালে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন ও অফিস সহায়ক সাখাওয়াত হোসেন প্রশিণরত মহিলাদের গর্ভবতি দেখিয়ে তাদের নামে চেক দিয়ে ব্যাংকে টাকা তুলতে পাঠানো হয়।তারা টাকা তুলে ব্যাংকের নিচতলায় নামলে অফিস সহকারি সাখাওয়াৎ হোসেন মহিলাদের কাছ থেকে সব টাকা নিয়ে নেয়।এভাবে মা শিশু সহায়ক কর্মসুচির ১৫-১৬ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়।প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বললেই এর সত্যতা মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তিনি বেশ কয়েকজন দরিদ্র মহিলাকে এনজিওর স্বাস্থ্য প্রকল্পে চাকরি দেয়ার নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা নিলেও তাদের চাকরি দেয়া হয়নি।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার পাশাপাশি অফিস সহায়ক সাখাওয়াত হোসেন ও কম যাননি। তিনিও ১৫ ও ১৭তম ব্যাচে ১২ মহিলার নামে ১ লাখ ৮০ হাজার ঋণ দেখিয়ে আত্মসাত করেন। এ তালিকায় রানীনগর ইউনিয়নের ভাটিকয়া গ্রামের ৭ জনের নামে ঋণ দেখানো হয়েছে। গ্রামের মো. বাদশার স্ত্রী মোছা: মিনা খাতুন,নুরু মোল্লার স্ত্রী নুরন্নাহার, মো. আজিজ মোল্লার স্ত্রী সাজেদা খাতুন, মো. সাইফুল রানার স্ত্রী মোছা সাথী খাতুন, মো, লুৎফর শেখের স্ত্রী মোছাম্মদ সোনা বানু, মো. আব্দুল খালেকের কন্যা পিংকী আক্তার মো. খবির উদ্দিনের কন্যা শারমিন খাতুনকে ইউপি চেয়ারনম্যান তৌফিকুল আলম পীযুষ জিজ্ঞাসাবাদ করলে হতদবিদ্র এ মহিলারা তাদের নামে ঋণ তুলে নেয়ার কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তারা এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান ।
ঋণ বিতরণের ৬০ জনের তালিকায় উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান,উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শামীম হোসেন,উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. নাজমুল হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলামের সা¶র রয়েছে। এখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে উপজেলা ঋণ মঞ্জুর কমিটির সকল সদস্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন ভুয়া ঋণ তুলে আত্মসাত করলেন ?
এ বিষয়ে সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম জানান উপজেলার সমš^য়ক হিসেবে সব দপ্তরের কাজ যাচাই বাছাই অনেক সময় সম্ভব হয়না।মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আফজাল হোসেন ঋণের তালিকা উপস্থাপন করেছেন তারা সই করেছেন তবে ঘটনাটি বড়ই দুঃখজনক ।এ ঘটনা তার কানে গেলে আফজাল হোসেনকে জিজ্ঞাসা করণে তিনি অস্বীকার করেন।তবে জেলা প্রশাসক সাহেবের কাছে অভিযোগ আসায় তিনি তদন্ত করতে নির্দেশনা দেয়ায় তদন্ত করা হচ্ছে ।তদন্তে প্রমাণিত হলে দায়ি কর্মকর্তা আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে ব্যবস্থা নিতে জানানো হবে।
সুজানগর মহিলা বিষয়ক অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর কবিরকে ফোন করা হলে তিনি আফজাল হোসেনের ঋণের টাকা আত্মসাতের ঘটনা স্বীকার করে বলেন আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর তাকে টাকাগুলো জমা দেয়ার জন্য বলেছি।তিনি ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের উপপরিচালককে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন বলেও জানান।
অফিস সহকারি সাখাওয়াত হোসেন তার নেয়া ঋণের কথা স্বীকার করে বলেন আমি ইতোমধ্যে টাকা জমা দিয়েছি অল্প টাকা বাকি আছে তা পরিশোধ করে দিব। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রেবেকা সুলতানার কাছে ঋণ জালিয়াতির ঘটনা জানতে চাইলে তিনি না জানার ভান করে বলেন আপনি মহিলাদেরকে আমার কাছে অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ দিতে বলবো কেন নিউজ করবো জানালে উপপরিচালক তা না করার কথা বলেন। নিউজ করলে আফজাল হোসেনের অবসরের টাকা বন্ধ হয়ে যাবে বলে তিনি এ নিয়ে না লিখার কথা বলেন। যদিও আফজাল হোসেন তার বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সুজানগর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে কিশোর কিশোরী ক্লাবের সদস্যদের প্রতি মাসে নাস্তার সরকারি বরাদ্দের টাকা নিয়েও নয় ছয় চলছে। বরাদ্দ আসে ক্লাব প্রতি ৩০ জনের ৩০ টাকা আর দেয়া হচ্ছে ক্লাব প্রতি ২৫ জনের ২৫ টাকা করে। এ টাকা থেকেও জেন্ডার প্রমোটর মলিনা খাতুন আর সুমি রানি কেটে ক্লাবপ্রতি ২৫ জনের ২০ টাকা বরাদ্দ দেয়। শেষে কিশোর কিশোরীদের কপালে ২০ টাকার নাস্তা জোটে ১টা কলা আর ১টা ডিম । গত ১৭ মার্চ ও ২৬শে মার্চ কিশোর কিশোরী ক্লাবের জাতীয় দিবস উৎযাপনে সরকার ১ হাজার করে বরাদ্দ দিলেও তাদের দেয়া হয় ২০০-৩০০ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো কোন অফিস ইক্যুপমেন্ট, কাচামাল কেনা হয়নি।সদ্য সমাপ্ত একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্পে ফ্রিজ, ওভেন ও গ্যাসের চুলা কেনার বরাদ্দ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা না কিনে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে সমুদয় টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে।