রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯ অপরাহ্ন

ই-পেপার

ইসলামে কোরবানীর গুরুত্ব ও শিক্ষা – মাওলানা: শামীম আহমেদ 

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩, ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ

কুরবুন বা কোরবানি অর্থ আত্মত্যাগ, উৎসর্গ বা বিসর্জন ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ করার নামই কোরবানি। প্রচলিত অর্থে কোরবানি হলো পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট জানোয়ার জবেহ করা। এ সম্পর্কে  সূরা হাজ-এ মহান রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন, আমি প্রত্যেক জাতির ওপর কোরবানির নিয়ম করেছি যাতে তারা চুতষ্পদ জন্তু জবেহ করে এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। সেইসাথে সূরা কাওসারে বলা হয়, তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।
কোরবানির উদ্দেশ্যঃ-
কোরবানির মুখ্য উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়ার মাধ্যমেই আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। সূরা আল-আনআম এর ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ’তায়ালা বলেন, বলো, আমার সালাত, আমার হজ্ব ও কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে। কোরবানি আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহর প্রেমে পূর্ণ তাকওয়া নিয়ে কোরবানি করতে হবে। জিলহজ মাসের দশ, এগারো, বারো তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এ কোরবানির উৎসব বা ঈদুল আজহা শুধু প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র নয়। মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উৎসর্গ করাই এর উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছায় না। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহকে রাজি-খুশি করা, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই হলো মুখ্য উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন, আমার কাছে এগুলোর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের মনের তাকওয়া।
 কোরবানীর ফজিলত ও গুরুত্বঃ-
কোরবানির দিন কোরবানি করা মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। কোরবানির পশুর রক্ত ভূমিতে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহ’তালার দরবারে কবুল হয়ে যায়। নবী করীম (সাঃ) বলেন, কোরবানির পশুর যত পশম থাকে তার পরিবর্তে ৩৩টি পুণ্য লেখা হয়ে থাকে। হজরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত এক হাদীস থেকে জানা যায় নবী করীম (সাঃ) বলেন, কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। সেইসাথে কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীস থেকে জানা যায় নবী করীম (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তির সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।
কোরবানির শিক্ষাঃ–
মানব জীবনে কোরবানির মূল শিক্ষা সমাজের অভাবগ্রস্তদের সহমর্মিতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা করা। সেইসাথে আল্লাহর রাস্তায় মানুষের আপন সম্পদ উৎসর্গ করা। যিনি যত পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবেন। তিনি আল্লাহর তত নৈকট্য লাভ করবেন। কোরবানির ত্যাগ বা উৎসর্গ একটি বড় ইবাদত। কোরবানির তাৎপর্য হল আমাদের ভেতরের পশুত্ব, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতাকে দূর করা। অন্তরের মধ্যে বসবাসকারী পশুকে জবাই করা। এবং সেই সাথে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা বিসর্জন দিয়ে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বোধে উজ্জীবিত হওয়া। এটাই বান্দার কাছে পবিত্র কোরবানির মহান শিক্ষা। এতে করে আমাদের মনে আত্মশুদ্ধি আসবে। সেইসাথে অর্জিত হবে মনের তাকওয়া। আল্লাহর প্রেম শুধু কোরবানির দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে, আজীবন অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বক্ষণ মনে জাগ্রত রাখতে হবে কোরবানির মহান শিক্ষাকে। সেইসাথে কোরবানি শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকরী মাধ্যম। ইসলাম মুসলিমদের কোরবানির বিধান দিয়ে তাওহীদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করণের পাশাপাশি এই শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে যে এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কোরবানি করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। এর দ্বারা একদিকে যেমন তাওহীদের বিশ্বাস শাণিত হয়। তেমনি মানুষকে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের বিবেককে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আর তবেই আমাদের পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর, শান্তিময় ও নিরাপদ।
[11/06, 17:16] Shamim Ahmed: দুটি ঈদ ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আজহা’ আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে দান করেছেন। এর জন্য পহেলা শাওয়াল এবং ১০ জিলহজ্ব এই দুটি দিনকেই ইসলাম বেছে নিয়েছে। দুই ঈদ প্রতি বছর এমন দুটি দিনকেই কেন্দ্র করে আসে, যখন মুমিন মুসলমানগণ সম্মিলতভাবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পন্ন করে। ঈদুল ফিতর সেই সময় আসে যখন মুমিনগণ পুরো একটি মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কাটিয়ে দেয়। আর ঈদুল আজহা তখন উদযাপন করা হয়, যখন হজ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পন্ন করা হয় লাখো কোটি মুসলমানগণ আরাফার ময়দানে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি নবজীবন লাভ করে। আর হজ্জে অংশ নিতে না পারা মুসলমানগণ কুরবানি করে ত্যাগের মহিমায় আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।
কুরবানি বলতে এমন ইবাদতকে বোঝানো হয়, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি, রাজি খুশি এবং নৈকট্য অর্জন করা যায়। হজরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে হাউসে কাউছার দান করেছি, তার শুকরিয়াস্বরূপ আপনি নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার) কুরবানি সম্পর্কে হজরত মিখজাফ ইবনে সালীম (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে সমবেত লোকদেরকে সম্বোধন করে একথা বলতে শুনেছি-‘হে লোক সকল! তোমারা জেনে রাখ যে, প্রত্যেক সামর্থ্যবান পরিবারের ওপর প্রত্যেক বছরই কুরবানি করা কর্তব্য আর যার সামর্থ্য নেই তাদের ওপর কুরবানি কর্তব্য নয়। কারণ আল্লাহতায়ালা কারো ওপর এমন কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, যা তার সাধ্যের বাইরে।’ কুরবানি করা বড় সওয়াবের কাজ। সুতরাং যাদের সার্মথ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, তাদের চেয়ে বড় হতভাগা নির্লজ্জ আর কেউ নেই। হাদিসে বর্ণিত আছে, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।
একবার সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কুরবানীর তাৎপর্য কী? রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোরবানী করা এটা তোমাদের ধর্মীয় পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম আবার আরজ করলেন, এতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে? নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম বললেন প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব হবে। আর কুরবানির দিন আল্লাহতায়ালার নিকট পশু জবাই অপেক্ষা অন্য কোনো আমল বেশি পছন্দনীয় নয়। কিয়ামতের দিন কুরবানিকৃত প্রাণী ও তার লোম খুর ও শিংহসহ উপস্থিত হবে। কুরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। কুরবানি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য হাসিলের জন্যই করা হয়। মহান আল্লাহতায়ালার পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন, তাকওয়া হচ্ছে কুরবানির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহর নিকট আমাদের কোরবানীর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না। বরং অন্তরের তাকওয়া ও পরহেজগারি পৌঁছে থাকে। সুতরাং কুরবানি করার আড়ালে যদি গোশত খাওয়া লৌকিকতা অথবা এরূপ কোনো হীন স্বার্থ জড়িত থাকে তাহলে সম্পূর্ণ কুরবানি বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কুরবানি একটি বড় ইবাদত। প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়। মনের সমস্ত চাহিদাকে আল্লাহর কাছে পেশ করে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করা। মানুষ যত বড় জন্তই কুরবানি করুক না কেন; তার গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং পৌঁছে মনের অবস্থা। কোরবানী দাতা পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছে কিনা এবং জন্তু ক্রয়ের সময় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি মনে ছিল কিনা? এ ব্যাপারগুলো ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। মূলত প্রতিটি ইবাদতই হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। সঠিক নিয়তবিহীন ইবাদত দ্বারা মূল মাকসাদে কখনো পৌঁছা যায় না।
জন্তু কুরবানির পেছনে রয়েছে হূদয়বিদারক এক ইতিহাস। আল্লাহর আদেশে হজরত ইবরাহীম (আ.) সে ইতিহাসের সূচনা করেছেন। তিনি আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজের সর্বস্ব বিলীন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। পরবর্তী জাতির জন্য রেখে গেছেন অনুসরণীয় স্মৃতি। আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালার হুকুমের আনুগত্য কীভাবে করতে হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুম পালনার্থে কলিজার টুকরা সন্তানকে কোরবানী করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। পিতাপুত্রের পূর্ণ আনুগত্যের মাঝে পরবর্তী লোকদের জন্য রয়েছে বহু শিক্ষাণীয় বিষয়। যা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের কাছে পরিষ্কার। আনুগত্যের এই ধারাকে কেয়ামত পর্যন্ত চালু রাখার জন্য আমাদের ওপর বছরে একবার পশু কোরবানীর বিধান রাখা হয়েছে। যে বিধানের মধ্যে মানুষের জন্য অনুকরণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। কোরবানি করা হজরত ইবরাহীম (আ.) এর একটি অনুকরণীয় আদর্শ। কোরবানি করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। নিজের ব্যক্তিক্ত নাম ফুটানোর জন্য নয়। কোরবানি মুসলিম সমাজের একটি ঐতিহ্য। বড় একটি ইবাদত। যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ কোরবানি দিয়ে এসেছে। ঈদের দিনগুলোতে সারা বিশ্বে লক্ষ কোটি পশু কোরবানি হয়। আল্লাহপাক এর মধ্যে বরকত রেখেছেন। আল্লাহপাক সমস্ত মুসলিম ভাইদেরকে দিল খুলে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর