শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০২:৩৯ অপরাহ্ন

ই-পেপার

আবু ইসহাকের জোঁক ও বর্তমান গ্রাম্য মহাজন – এম এ মাসুদ

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২, ১:০৮ অপরাহ্ণ

তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি অবলম্বনে লেখা আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পটি যখন পড়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম শুধু ভাগচাষি বা বর্গাচাষিদের ক্ষেত্রেই মনে হয় জোঁক শব্দটি প্রযোজ্য। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে রূপক সেই শব্দটির মিল খুঁজে পাওয়া যায় সুদে অর্থ ধার দেওয়া গ্রাম্য মহাজনদের সঙ্গে। যারা এই মহাজনিকে আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তারা অর্থনীতি না পড়লেও সুদের সংজ্ঞাটি যেন বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। যাতে বলা হয়েছে, ‘সুদ হলো নগদ অর্থ হাতছাড়া করার পুরস্কার।’ একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, ‘সুদ দিন, ধার নিন।’ আপনি যত আপনজনই হন না কেন, গ্রাম্য মহাজনরা আপনাকে ধারে টাকা দেবে না। যখন দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক আকারে লাভ দেওয়ার প্রস্তাব দেবেন; তখন মহাজনদের মুখে পরিচিত একটি বাক্য শুনতে পাওয়া যায়- আমার তো নেই, দেখি আরেকজনের কাছে পাই কি না! টাকা দেওয়ার সময় বলবে, অন্যের টাকা, মাস শেষে যেন ঘুরতে না হয়। টাকা ধার দেওয়ার কী অভিনব কায়দা তাদের!
অর্থনীতিতে একজন মহাজন যখন কৃষককে সুদে ঋণ দেন, তখন তাকে বলা হয় ‘গ্রাম্য মহাজন।’ এই গ্রাম্য মহাজনরা কৃষিঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম। শুধু কৃষকই নন, এখন গ্রাম্য মহাজনদের থেকে সুদে ঋণ নিচ্ছেন মুটে, মজুর, চাকরিজীবীসহ অনেকেই। স্বল্প মূলধনে বেশি লাভ হওয়ায় সাধারণ মানুুষের মাঝেও কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন গ্রাম্য মহাজনিকে আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে। বাড়তি লাভের আশায় পিছিয়ে নেই নারীরাও, কেউ কেউ সম্পৃক্ত হচ্ছেন লাভজনক এমন পেশায়। এমনকি দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে সমিতির নামে গড়ে উঠেছে সুদের কারবার। অতীতে মহাজনরা ঋণ দিতেন সুদের বিনিময়ে, আর জামানত হিসেবে রেখে দিতেন স্বর্ণালঙ্কার, পিতল বা কাঁসার বাসন। কিন্তু বর্তমানে গ্রাম্য মহাজনরা চাকরিজীবী, সাধারণ কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা শ্রমজীবীদের কাছ থেকে ঋণের জামানত হিসেবে রেখে দিচ্ছেন স্বাক্ষরকৃত ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প। এমন ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প দিতে হয় যেকোনো পরিমাণ টাকা ধার নেওয়ার ক্ষেত্রেই।

অভাবের মাত্রাভেদে সুদের হারও কম-বেশি হতে দেখা যায়। বিশেষত শ্রমজীবী, হাটবাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের (মাছ, সবজি) বেলায় সুদের হার শতকরা ১০ থেকে ১৫ টাকা হারে। আর চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে মাসিক সুদের হার শতকরা ৪-৬ টাকা। মাস শেষ হতে না হতেই ঋণগ্রহীতা দেনাদারকে সুদের জন্য তাড়া দিতেও দেখা যায়। চাকরিজীবীদের মাসিক বেতন ব্যাংকে জমা হওয়া মাত্রই দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে দেখা মিলবে চেকের বান্ডিলসহ গ্রাম্য মহাজনদের।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান হওয়ায় কৃষিতে রয়েছে মৌসুমি বেকারত্ব, ছদ্ম বেকারত্ব, প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব। কৃষিতে এ ধরনের বেকারত্ব থাকায় কৃষিশ্রমিকদের অধিকাংশ সময়ই অলস সময় কাটাতে হয় বলে আয়ও কমে যায়। আবার বাংলাদেশের কৃষি মৌসুমি বায়ুর জুয়াখেলা অর্থাৎ বন্যা, খরা, শিলাবৃষ্টি বা জলোচ্ছ¡াসে হয় ফসলহানি। এ ছাড়া ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা হন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষুদে ব্যবসায় অনেক সময় দেখা দেয় মন্দাভাব। ফলস্বরূপ মহাজনদের নির্ধারিত সুদের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলেও শুরু হয় চক্রবৃদ্ধি হারে আদায়। আবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে চাইলেও মহাজনরা পুরো টাকা একসঙ্গে ফেরত চাওয়ায় তা অনেক সময় ঋণগ্রস্তের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। শেষ পর্যন্ত মহাজনদের অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে তখন তারা বাধ্য হন অন্য মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে। ওই ঋণ নিয়ে সুদ দিচ্ছেন আগের মহাজনকে। এভাবে ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আটকা পড়েন ঋণের সীমাহীন জালে।

চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বৃদ্ধির ফলে একসময় খেটে খাওয়া মানুষ মহাজনদের ভয়ে হাটবাজারে পর্যন্ত যেতে সাহস পান না। কারণ তাদের অনেকেই প্রভাবশালী হওয়ায় ঋণগ্রস্ত কৃষক অপমানিত হওয়ার ভয়ে ভিটেমাটি বিক্রি বা বন্ধক রেখে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন। শেষে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম ছাড়ে এসব মানুষ। ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে আসার দুঃসাহসও তাদের আর থাকে না। আবার কখনো কখনো সুদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অনেকের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। সম্প্রতি ঠিক তেমন একটি ঘটনার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামে সুদের টাকা দিতে না পারায় গলায় চাকু ঠেকিয়ে এক গৃহবধূকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। বুধবার ভুক্তভোগী নারী শেরালী ও ইয়াসিন নামে দুইজনের বিরুদ্ধে শাহজাদপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই নারীর বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ঘটনার রাতে আমার স্বামী ট্রাকের হেল্পারীর কাজে চলে যায়। গভীর রাতে শেরালী ও ইয়াসিন মদ পান করে আমার বাড়িতে এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। আমি ঘর থেকে বাইরে বের হলে তারা জানায়, ‘তোর স্বামীর কাছে ১৬ বছর আগের পাওনা সুদের টাকা না দেয়ায় তাকে বাড়ির বাইরে বেঁধে রাখা হয়েছে। তুই গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আয়। আমি সরল মনে তাদের কথায় বাড়ির বাইরে গেলে তারা আমার গলায় ছুরি ধরে হত্যার ভয় দেখিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশের নুকালী স্কুলে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। পরে আমার স্বামী বাড়ি এলে তাকে বিষয়টি জানাই।
গত ২৬ আগস্ট নাটোরের বরাইগ্রামে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে দম্পতির আত্নহত্যা এবং বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার গ্রাম্য মহাজনদের
নির্যাতনের খবরতো হামেশাই আসছে। এমন নির্যাতনের চিত্রগুলো সমাজের বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে। এগুলো সামান্য উদাহরণ মাত্র। বাস্তবতা হলো আরো ভয়ংকর।
শুধু তাই নয়, গ্রাম্য মহাজনরা তাদের কাছে রক্ষিত স্বাক্ষর করা ফাঁকা ব্যাংক চেকে নিজের ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক লিখে আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা ঠুকে দেন। যা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। আবার স্ট্যাম্পে লিখে থানা বা সমাজের নেতৃস্থানীয়দের কাছে বিচার দিতে ও চাইতেও দেখা যায় তাদের। ফলে প্রান্তিক কৃষক হয়ে পড়েন ভূমিহীন, ভিটেমাটিওয়ালাহীন, গৃহহীন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারিয়ে হন বেকার আর শ্রমজীবীরা হন গ্রাম ছাড়া। হয়ে পড়েন দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র। যারা একসময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন, তারাই এখন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। অথচ এসব শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের সুফল ভোগ করছেন গ্রাম্য মহাজনরা। তারা হচ্ছেন পুঁজিপতি, কিনছেন জমি, দামি গাড়ি, করছেন বাড়ি। আর বাজারে বড় বড় মাছ কেনা তো থাকছেই। এই মহাজনদের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ খ্যাত লেখক আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পের সঙ্গে। ওই গল্পের ওসমান হচ্ছেন বর্তমান সময়ে মহাজনদের কাছে থেকে ঋণগ্রহণকারী আর ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর ছেলে ইউসুফের প্রতিনিধিত্ব করছেন এই গ্রাম্য মহাজনরা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দারিদ্র্য হার এক যুগের ব্যবধানে ১৮.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্য হার ছিল ৪০ শতাংশ এবং অতি দারিদ্রের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দারিদ্র এবং অতি দারিদ্র্যের এই হার নামিয়ে আনা হয়েছে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫ শতাংশে।
দেশে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রতার হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সরকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক সুরক্ষা নেটের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছে। এক্ষেত্রে সরকার দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
তবে হঠাৎ কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে সৃষ্ট আয়-রোজগারের অস্থিতিশীলতা কিছু লোককে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে আনতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে দারিদ্রের হার ১২.৩ এবং অতি দারিদ্রের হার ৪.৫ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
সে যাই হোক, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য হার ৯.৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চাইলে গ্রাম্য মহাজনদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তাহলেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ, কমবে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর