মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৩:১০ পূর্বাহ্ন

ই-পেপার

ইমরান খানের রাজনীতি এখন কোন পথে?

অনলাইন ডেস্ক:
আপডেট সময়: শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০২২, ৮:৪৯ অপরাহ্ণ

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত সপ্তাহে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। এরপর তার দল পিটিআই আবার শাহবাজ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। তার ওপর হামলার জন্য ইমরান খান পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ্ খান এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরকে দায়ী করেছেন। তবে ওই তিনজন এরই মধ্যে ইমরান খানের অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খান চেষ্টা করছিলেন বড় আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এখন প্রশ্ন উঠছে যে, পাকিস্তানের রাজনীতির এই জটিল গোলকধাঁধায় ইমরান খানের সামনে এখন কোন পথ খোলা রয়েছে? তিনি কি আন্দোলন চালিয়ে যাবেন? নাকি সমঝোতার একটি পথ খুঁজবেন?

এই কথাটা পাকিস্তানে বেশ চালু রয়েছে – দেশটির রাজনীতিতে এখন দুটো ধ্রুব তারা – বুলেটের রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনীর প্রভাব। প্রথমটি চালু হয় স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে, ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে। রাওয়ালপিন্ডিতে ভাষণ দেয়ার সময় গুলি করে খুন করা হয় ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে। তার হত্যা রহস্যের কোনো মীমাংসা হয়নি আজও।

পাকিস্তানে হত্যার রাজনীতি এর রের সাত দশক ধরে একের পর এক হত্যার শিকার হন শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতা – ১৯৭৩ সালে বালোচ নেতা আব্দুস সামাদ আচাকজাই, ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক, ২০০৭ সালে বেনজীর ভুট্টো, আর তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৯৬ সালে সাতজন সঙ্গীসহ নিহত হন তারই ভাই মীর মুর্তাজা ভুট্টো। এছাড়াও রয়েছেন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা, যাদের মধ্যে কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। আবার কেউ হত্যা প্রচেষ্টা থেকে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেছেন।

সেই বিবেচনায় অবশ্য ইমরান খান নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করতে পারেন। এমনটাই মনে করছেন লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা। ইমরান খানের ওপর গুলি ছিল ‘ওয়ার্নিং শট’। শুধুই তাকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘এই ষড়যন্ত্রের সাথে এক বা একাধিক ব্যক্তি জড়িত। কিংবা প্রচ্ছন্নভাবে তারা এতে সায় দিয়েছেন। এটা একক কোনো আততায়ীর কাজ নয়।’

ইমরান খান যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করছেন, তাদের মধ্যে থেকে কেউ এতে জড়িত থাকলে তা অবাক হওয়ার মতো বিষয় হবে না। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ইমরান খানকে বরাবরই সামরিক বাহিনীর ‘ব্লু আইড বয়’ নামে অভিহিত করে এসেছেন।

ইমরান খান ও সেনাবাহিনী একজন ক্রিকেট তারকা, একজন ‘প্লে বয়’র ইমেজ ভেঙে তার রাজনীতির মাঠে নামা, দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করা, তেহরিক-ই-ইনসাফ নামে দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া– এসবের পেছনে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ ও সক্রিয় সমর্থন ছিল বলেই মনে করা হয়। তাহলে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক কেন তিক্ত হয়ে গেল?

জবাবটা ইমরান খান সম্প্রতি নিজেই কিছুটা দিয়েছেন। তার ওপর হামলার পর পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেখতে পেলেন সামরিক বাহিনীর বাধার মুখে তিনি অনেক কিছুই করতে পারছেন না। বিশেষভাবে, দুর্নীতি রোধকারী সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো বা ন্যাব কাজ করতো সামরিক বাহিনীর নির্দেশে। ইমরান খান বলছেন, “ন্যাব ছিল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। আমি কিছুই করতে পারিনি। তারা বলত, ‘হ্যাঁ, মামলা রয়েছে, আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ কিন্তু কিছুই হতো না।”

পাকিস্তানে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আসলে ন্যাবকে নিয়ন্ত্রণ করে এস্টাবলিশমেন্ট এবং সংস্থাটি তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে। এটার কাজ ছিল রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির ফাইল তৈরি করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।’

দুর্নীতি সাফ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমরান খান ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি সে কাজে ব্যর্থ হন। পাশাপাশি দেশের চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং করোনাভাইরাস মহামারি সামলানোর কাজেও তিনি যে খুব একটা সফল হয়েছেন, তা বলা যায় না। সম্পর্কের তিক্ততা সবচেয়ে তীব্র হয় যখন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সেনা সংস্থা আইএসআই-এর নতুন প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এরপর থেকে সামরিক বাহিনী তার ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল করে দিতে শুরু করে এবং তিনিও সামরিক বাহিনী সম্পর্কে সরব হতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে জাতীয় পরিষদে আস্থা ভোটে হেরে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসান আসকারী রিজভী পাকিস্তানের একজন খ্যাতনামা রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি মনে করেন, ইমরান খানকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর যে ‘রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট’ তা সমস্যায় পড়লেও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। রাজনীতির মাঠে একজন নতুন মুখ, যিনি তৃতীয় শক্তি হিসেবে পাকিস্তান পিপলস পার্টি কিংবা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নাওয়াজ (পিএমএল)-এর মতো পুরনো দলগুলির মুখোমুখি দাঁড়াবেন। তিনি দুর্নীতির মূলোৎপাটন করবেন, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলবেন, সমাজের মধ্যবিত্ত অংশ যার কথায় বিশ্বাস করবেন – এসবই ছিল সেই পরীক্ষার অংশ। সমস্যা হলো, তিনি অনেক প্রতিশ্রুতিই পালন করতে পারেননি। রিজভী বলছেন, ‘ফলে সামরিক বাহিনী মনে করলো, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো গেলেই তিনি রাজনীতিতে মূল্যহীন হয়ে পড়বেন। কিন্তু ঘটলো উল্টো ঘটনা।’

দেশের প্রায় ৪৪ শতাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইতোমধ্যেই ‘ইমরান মন্ত্রে’ দীক্ষিত। তারা এখনো নিজেদের মধ্যে ইমরান খানের রাজনৈতিক ছায়া দেখতে পায়। আর সেটাই সামরিক বাহিনীর জন্য হয়েছে সমস্যা, বলছেন ড. রিজভী। তার মতে, ফলে, তারা ইমরান খানকে এখনই ত্যাগ করতে পারছে না।

ইমরান খানের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কে আরেকটা দিক ব্যাখ্যা করছিলেন লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা। তিনি বলেন, পাকিস্তানের গোড়ার দিকে সামরিক বাহিনীর অধিনায়করা এসেছিলেন মূলত সে দেশের ভূস্বামী বা জমিদার শ্রেণি থেকে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। এখনকার জেনারেলদের একটা বড় অংশ মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান। ফলে এরা বাড়ি এসে ঘরে ঢুকেই তাদের স্ত্রী বা সন্তানদের মুখে ইমরান খানের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাই শুনতে পান। তারা সমাজের যে অংশে ঘোরাফেরা করেন, তারাও ইমরান খানের রাজনৈতিক আদর্শের কথাই বলেন।’

এ নিয়ে এক নিবন্ধে ড. আয়েশা সিদ্দিকা লিখেছেন, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব থেকে যেসব আলোচনা তৈরি হয়েছে, একটি পুরো প্রজন্ম এখন তা ঝেড়ে ফেতে পারছে না। দুর্নীতির অভিযোগে নেতাদের অভিযুক্ত হওয়া ও দোষী প্রমাণিত হওয়া, পরে কারাগার থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে দেখে জনতার আদালতে শাস্তি দেওয়ার দিকে মানুষের ঝোঁক আরও বেড়েছে।

ইমরানের সামনে পথ কী? ড. সিদ্দিকা উল্লেখ করছেন, এমন নয় যে পিএমএল-এন বা পিপিপি’র নেতারা আদালতে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে প্রমাণিত হয়েছেন। তার মতে, কেবল এক শ্রেণির মানুষের চোখে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবেই চিহ্নিত থেকে যাবেন, যারা বিশ্বাস করেন এদের দোষী প্রমাণিত করা যায়নি। এ কারণে যে বিচার বিভাগসহ সমস্ত প্রতিষ্ঠানও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে রাজনীতির মসনদ থেকে রাজপথে ফেরা ইমরান খান এখন কী করবেন?

এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ডন পত্রিকায় ইমরান খানের সাক্ষাৎকারে। সেখানে মন্তব্য করা হয়েছে, তার অনেক অনুগামী এখন তাকে নতুন করে জন্ম নেয়া ‘বর্ন এগেইন’ গণতন্ত্রী হিসেবে দেখেন। সামরিক ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে সম্পর্কটি ঠিক কী হবে, সেই সমীকরণের শর্ত তিনি নতুন করে তৈরি করতে চান।

ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন, এর মানে হলো ইমরানের আদালতে গোটা সামরিক বাহিনীর বিচার হবে না। বিচার হবে কয়েকজন জেনারেলের। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইলে সামরিক বাহিনীকে তাকে হাত রাখতেই হবে। চলতি মাসেই সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আসছে – বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার জায়গায় নিয়োগ করা হবে নতুন সেনাপ্রধান। সামরিক বাহিনীর নতুন নেতৃত্ব চাইবে ইমরান খানের আন্দোলনের জোয়ার যেন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। তাদের গোষ্ঠী স্বার্থ যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, মনে করেন আয়েশা সিদ্দিকা।

ইমরান খানের সামনে তিনটি পথ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারী রিজভীর মতে, ইমরান খানের সামনে এখন রয়েছে তিনটি পথ। প্রথমত, তিনি আবার মিছিল নিয়ে ইসলামাবাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকবেন। ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে তার অনুগামী জনস্রোত পাকিস্তানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। এসব প্রচারের ফসল তিনি ঘরে তুলবেন।

দ্বিতীয় পথটি হলো, তিনি আন্দোলন ত্যাগ করবেন এবং সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য তৈরি হবেন। তবে শাহবাজ শরিফ সরকার ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কি-না, তা নিয়ে বিশ্লেষক রিজভীর সন্দেহ রয়েছে। তার মতে, তৃতীয় পথটি হলো, তার দ্রুত নির্বাচনের দাবি। সামরিক বাহিনী ও ক্ষমতার অন্যান্য স্তম্ভের সাথে আপসরফা করে তিনি একটি মাঝামাঝি পথ বের করার চেষ্টা করবেন এবং মার্চ মাসে নির্বাচনের ব্যাপারে একটা মতৈক্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন, বলেছেন মি. রিজভী।

ইমরানের ১০-বছর মেয়াদী প্রজেক্ট তাহলে এই পর্যায়ে সামরিক বাহিনী ইমরান খানের কাছ থেকে কী আশা করতে পারে? – এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম ড. আয়েশা সিদ্দিকাকে। তিনি জানালেন, ইমরান খানকে নিয়ে সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের ‘১০-বছর মেয়াদী প্রজেক্ট’ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। নতুন সেনাপ্রধান চাইবেন দরকষাকষি করতে। সামরিক বাহিনী চাইবে, ইমরান খানকে কিছু দিয়ে কিছু তার আছ থেকে আদায় করতে। ইমরান খানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, সামরিক বাহিনী চাইবে তেমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।

পিটিআইয়ের রাজপথের আন্দোলন এবং তাদের সাথে প্রতিপক্ষ পিএমএল এবং পিপিপি’র সংঘাত ছড়িয়ে পড়া, বা এর জেরে দেশে সামরিক শাসন জারির কোন সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখছেন না ড. সিদ্দিকা। তবে দেশের তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, পাঞ্জাবে ভয়াবহ বন্যার প্রভাব, বালোচিস্তানে অস্থিরতার পাশাপাশি সর্বশেষ এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উদ্বেগকে যে আরও বাড়িয়ে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সূত্র : বিবিসি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com