একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যকার ও অভিনেতা মাসুম আজিজের মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছে অভিনেতা, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন নাট্যজগতের শিল্পী-কুশলীরা। তাদের মুখ ছিল মলিন, কারো আবার চোখের কোণে জায়গা করে নিয়েছে জল। কারণ দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় যে মানুষটা নাটকের মধ্যে ডুবে ছিলেন, সবার সঙ্গে মিশে ছিলেন, তিনি চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে।
মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয় মাসুম আজিজের মরদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এই শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে এসেছেন আসাদুজ্জামান নূর, দিলারা জামান, মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, নাদের চৌধুরী, আহসান হাবিব নাসিম, সালাহউদ্দিন লাভলু, চয়নিকা চৌধুরী, আবদুন নূর সজলসহ অনেকেই। নাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও মাসুম আজিজের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। মাসুম আজিজ শুধু অভিনেতা নন, গানের মানুষও ছিলেন। তার সরল-সুরেলা গায়কীতে মুগ্ধ হতেন আশপাশের মানুষ। তাই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সমবেত কণ্ঠে গান গেয়েই অভিনেতাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। গানটি হলো- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি’। উপস্থিত বিখ্যাতজনরাও মাসুম আজিজের স্মরণে গানটিতে কণ্ঠ মেলান।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘মাসুম আজিজ চলে যাওয়া মানে, অঙ্গীকারাবদ্ধ নাট্যব্যক্তি যারা, তাদের মধ্যে একজন প্রধান ব্যক্তি আজকে চলে গেলেন। আমি এই মহান শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’
মামুনুর রশীদের সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন মাসুম আজিজ। নিজের শিষ্যের প্রয়াণে তাই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বক্তব্য রাখতে গিয়ে বারবার তার গলা ধরে আসে, ভিজে আসে চোখ। তিনি বলেন, ‘একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ছে খুব, একটি অনুষ্ঠান থেকে মাসুম গান গেয়ে ফিরছিল, ভূপেন হাজারিকার গান; আমি ফিরছিলাম নাটক করে। দুজন রিকশায়; ও জানাল দেশে চলে যাবে। জানতে চাইলাম কেন? কারণ সব রকম বৈষয়িক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়েছে। আমি তখন চট করেই বলে ফেললাম, তুমি থাকো, আমি দেখব। সেই থেকে ও আমার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করল। আর ঢাকা পদাতিকের সঙ্গে তো সে আছেই। তার সেইসব নাটকে অভিনয় দেখে আগে থেকেই আমি মুগ্ধ ছিলাম।’
নাদের চৌধুরীর সঙ্গেও দীর্ঘদিনের সখ্য ছিল মাসুম আজিজের। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে এ অভিনেতা বললেন, ‘প্রায় তিন-চার যুগের সম্পর্ক; অনেক আনন্দ, কষ্ট, ভালো লাগার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। মাসুম ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাক, এই কামনা করি।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘সংগঠনের সম্মেলন থাকার কারণে মাসুম ভাইয়ের অসুস্থতার সময় যেতে পারিনি। কিন্তু টেলিফোনে খবর নিয়েছি। ৯ অক্টোবর সম্মেলন শেষ হলো, ১০ তারিখেই আমি চলে গেলাম মাসুম ভাইয়ের বাসায়, সেই প্রিয়জনকে আজ শেষ বিদায় দিচ্ছি।’ অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, মাসুম ভাই অত্যন্ত কাজপাগল মানুষ ছিলেন। বড় অসময়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
মাসুম আজিজের পুত্র উৎস জামান কান্না চেপে বলেছেন, ‘আমি আসলে কী বলব! আমার বাবাকে যে দেশের মানুষ কেমন ভালোবাসেন, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।’
এর আগে মাসুম আজিজের জানাজা হয় বনশ্রী কেন্দ্রীয় মসজিদে। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে মাসুম আজিজের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অভিনেতার নিথর দেহ নিয়ে ফ্রিজার ভ্যান রওনা করে পাবনার ফরিদপুরের উদ্দেশে। সেখানেই দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করার কথা রয়েছে।