জন্মলগ্ন থেকেই নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মানবসন্তানকে তার অভীষ্ঠলক্ষ্যে পৌঁছতে হয়। মানবজীবনে সুখ-দুঃখ যেন অলঙ্ঘনীয় এক নিয়তি। চিরজীবন ধারাবাহিকভাবে যেমন কেউ দুঃখ পায় না, ঠিক একইভাবে সুখের মুখও কেউ দেখে না।
জগতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যার মনে কোনো দুঃখ ও কষ্ট নেই। অবস্থাভেদে হয়তো দুঃখ, কষ্টের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে, তবে একেবারে নেই বোধকরি এমনটি বলা যায় না। আমরা যা কিছুই করি না কেন, তার পিছনে রয়েছে আশা বা অভাববোধ এবং এটি জীবনব্যাপী একটি প্রক্রিয়া। সব আশা বা অভাব একই সাথে পুরণ হয় না। কিছু কিছু আশা অপূর্ণও থেকে যায় বা থাকবে। মূলত এই যে, প্রত্যাশিত আকাঙ্খা বা চাহিদা পূরণ করতে না পারা থেকেই বিষন্নতায় ভোগে। বার বার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি একজন মানুষকে হতাশ করে যার পরিণামে সে আত্মহননের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
প্রখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তাঁর“ঞযব ঝঁরপরফব ’ গ্রন্থে আত্মহত্যার ৪টি কারণ তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো- আত্মকেন্দ্রিকতা, নৈরাজ্য, পরার্থ ও হতাশা।
মৃত্যু নামক শব্দটি যে কোনো মানুষের কাছেই ভয়ের। কিন্তু তারপরেও থামছে না আতœহত্যার মতো ঘটনা। এর কারণ হলো-
কোনো কিছু অর্জন করার আশা করে তা অর্জন করতে না পারার ব্যর্থতা, বাবা-মাসহ আপনজনের অকাল মৃত্যুজনিত বেদনা বা শোক, ভালোবেসে সেই ভালবাসার মানুষটিকে কাছে না পাওয়ার মনঃকষ্ট, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও কর্মসংস্হান না হওয়ায় বেকারত্বজনিত হতাশা, ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, নিঃসঙ্গতা, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট, মেয়েদের প্রতি বখাটেদের উৎপাত, মাদকাসক্তি, মা-বাবার সামান্য বকুনি, নারী নির্যাতন, যৌতুক, ধর্ষণ ও ব্লাকমেইল কিংবা অভিমানে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। প্রতিভাবান তরুণ- তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, প্রকৌশল বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থেকে স্কুলপড়ুয়া কিশোর- কিশোরীও আত্মহত্যা করেছেন গত কয়েক মাসে।
গতকাল শুক্রবার আঁচল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আতœহত্যা করে ৭৬ জন। এর মধ্যে ৪৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। তবে সবচেয়ে বেশি আতœহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। তাদের সংখ্যা ১৯৪ জন। এদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯৯ শতাংশ পুরুষ ও ৬৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। আর চলতি বছরে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যা শিউরে রীতিমতো ওঠার মতো!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আতœহত্যা করেন ৮ লাখ মানুষ। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে ১১ হাজার মানুষ আতœহত্যা করেছে। আতœহত্যার এমন প্রবণতা বৃদ্ধি একদিকে যেমন আমাদের সামাজিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে, অন্যদিকে তেমনি উদ্বিগ্ন করে তুলছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে।
আত্মহত্যার পরিণাম সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)। অর্থাৎ চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
যেহেতু আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে বাড়ছে তাই এই ভয়ংকর প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে সরকারি ও বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি মাকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান বাসা থেকে কখন বের হয়, কখন ফিরে, রুমে কী করে, কোথায় যায়, আর মিশেই বা কার সাথে। শাসনের পাশাপাশি সন্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে বন্ধুত্বের মতো। চাকুরির বয়স সীমা বিবেচনার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে যুবদের। দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির উপর অতিশয় নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে নানা জটিলতা। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এজন্য মূল্যবোধগুলোর চর্চা করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামজিক জীবনে এগুলো ধারণ করতে পারলে আত্মহননের মতো ঘটনাগুলো কমে আসবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। তবে আশার কথা হলো- গত ১ সেপ্টেম্বর ইউনিসেফের সহায়তায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক ফার্স্ট এইড (পার্ট ১)’ অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্স তৈরি করে তা বর্তমানে মুক্তপাঠে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দীর্ঘ প্রায় আঠারো মাস কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও খেলাধুলা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে নানা মানসিক চাপ পরিলক্ষিত হওয়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মানসিক চাপ নিরসনের লক্ষ্যে সব শিক্ষকের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক ফার্স্ট এইড (পার্ট ১) অনলাইন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষককে অনলাইনে মুক্তপাঠের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কমবে বলে বিশ্বাস করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে- আত্মহননই একমাত্র সমাধান নয়। অভাব বা অপ্রাপ্তি থাকবে, এটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আকস্মিক দুর্যোগ বা বিপদে ভেঙে না পড়ে বরং সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে দৃঢ়চিত্তে। চাওয়া-পাওয়াকে পূরণ করতে দৃঢ়ভাবে অবিরাম প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দুঃখ, কষ্ট, বিপদ দেখে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্ধকারই কেবল মানুষের জীবনে অনিবার্য সত্য নয়, আঁধারের মাঝেই আবার উদিত হবে স্নিগ্ধ চাঁদ। দূরীভূত হবে জীবনের সকল অন্ধকার। উপভোগ করতে হবে আমাদের ছোট্ট জীবনকে। সর্বোপরি মহান স্রষ্টার প্রতি রাখতে হবে আমাদের অগাধ বিশ্বাস। ভালোবাসতে হবে ছোট্ট জীবনটাকে। তবেই কমবে আত্মহত্যার প্রবণতা। শান্তিময় হয়ে উঠবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এম এ মাসুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
masud.org2018@gmail.com