মাহবুব-উল-আলম :
দেশের ২২৭টি বেসরকারি সংস্কৃত-পালি কলেজ ও টোলে’র শিক্ষকদের ৪০ বছরে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাদের মাসিক বেতন ১৭৯ টাকা। কলেজগুলোর অবস্থাও দৈন্যদশা। সরকার অনুমোদিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের স্কেল অনুযায়ী বেতন দিলেও মাউশি ওই কলেজের শিক্ষকদের যুগ যুগ ধরে অসম্মানজনক ভাতা দিয়ে বৈষম্যমুলক আচরণ করছে বলে শিক্ষকরা অভিযোগ করেন।
জানাগেছে,দেশ স্বাধীনের পরও দেশে এরকম অনেক কলেজ গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি পুরাতন কলেজগুলোও রয়েছে। পাবনার ভাঙ্গুড়া পৌরসভার কালিবাড়ি মন্দির প্রাঙ্গণে ১৯৭৭ সালে বীণাপাণি সংস্কৃত কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক কলেজটি স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘মাউশি’এখানকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদান শুরু করে। তখন এই কলেজের জনবল কাঠামো অনুযায়ী একজন অধ্যক্ষ,দু’জন প্রভাষক ও একজন চতুর্থ শেণির কর্মচারীর পদায়ন দেওয়া হয়। কলেজটির বয়স এখন চল্লিশ বছর কিন্তু জনবল কাঠামো যা তাই রয়েছে,বেতনও বাড়েনি! অথচ সাধারণ শিক্ষায় একজন কলেজ শিক্ষক শুরুতে ২২হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান।
উল্লেখ্য, এসব কলেজে পঠিত বিষয়গুলো হলো কাব্য,পলাশ,শ্রীহট্ট শাস্ত্র,গীতা শাস্ত্র,জ্যেতিষশাস্ত্র,আযুর্বেদ শাস্ত্র, পাণিণি ও পুরোহিত শাস্ত্র। শিক্ষার্থীরা প্রথম বছরে ‘আদ্য’ , দ্বিতীয় বছরে ‘মধ্য’ ও তৃতীয় বছরে ‘উপাধি’ ডিগ্রি অর্জন করে। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা কেবল এই কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।
তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য প্রতি শিক্ষা বর্ষেই এখানে ভর্তি কার্যক্রম চলে। প্রতিটি ব্যাচে দশজন শিক্ষার্থী থাকা আবশ্যক। সেখানে ভাঙ্গুড়া বীণাপাণি সংস্কৃত কলেজে ২০১৭ সালের চুড়ান্ত পরীক্ষায় ৮২জন, ২০১৮ সালে ৭৫জন এবং ২০১৯ সালে ৬০জন ছাত্র-ছাত্রী অংশ গ্রহন করে এবং শতভাগ পাস করে।
প্রবীন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ খান বলেন ১৯৭৩-৭৪ সালে সরকার অনুমোদিত টোলের একজন পন্ডিত মশাই প্রতি মাসে সরকারি ভাতা পেতেন ৫০ টাকা। কলেজের মাষ্টার্স ডিগ্রিধারী প্রভাষকও পেতেন ৫০টাকা। ১৯৮০ সাল থেকে স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয় এবং শিক্ষকরা তখন থেকে স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকরাও একই নিয়মে ভাতা পাওয়ার অধিকারী।
হিন্দু বৈদ্ধ,খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ভাঙ্গুড়া উপজেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ভবেশ চন্দ্র দে বলেন, দেশের বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের জাতীয় স্কেলে বেতন দিলেও সংস্কৃত কলেজ শিক্ষকদের সাথে বৈষম্যমুলক আচরণ করা হচ্ছে ! ভাঙ্গুড়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ব্যাংকার মলয় কুমার দেব সংস্কৃত কলেজ শিক্ষকদের জাতীয় স্কেলে বেতন প্রদান ও এসব কলেজের অবকাঠামো নির্মানের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান।
দেশের এরকম ২২৭টি কলেজের অধ্যক্ষ ও দু’জন প্রভাষক মহার্ঘ ভাতাসহ প্রতি মাসে পাচ্ছেন ১৭৯ টাকা করে এবং একজন এমএলএসএস পাচ্ছেন ৭৮ টাকা। মাউশি ৪০ বছরেও তাদের বেতন-ভাতার অনুদান অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত স্কেল অনুযায়ী দেয়নি। এমনকি এখানকার শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও দেওয়া হয়না। এ সময়ে কলেজের কোনো প্রকার অবকাঠামো নির্মাণে সরকারি কোনো অনুদানও পাওয়া যায়নি। এজন্য কলেজের শিক্ষক,শিক্ষার্থী ও ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। যদিও এখানকার একজন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও পালি বিষয়ে সম্মান শেণিতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে।
পাবনার ভাঙ্গুড়া বীণাপাণি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ শ্রী বিকাশ চন্দ চন্দ্র এমএ.ডবল তীর্থ(কাব্য ও মুগ্ধরোধ)বলেন,কারিগরি কলেজের আদলে আমরা পাঠদান করছি অথচ সরকার আমাদের মুল্যায়ন করছেনা। এছাড়া বেসরকারি কলেজ ও রেজিট্রিকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকার তাদের স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রদান করলেও তাদের দিচ্ছেনা। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে আরো বলেন, এ যুগে কোনো কলেজ শিক্ষকের বেতন ১৭৯ টাকা হয় ? মাউশি তাদের সাথে বৈষম্যমুলক আচরণ করছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
একই কথা শুনালেন রংপুর জেলার বদরগঞ্জ বীণাপাণি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ তপন কুমার সাহা । তিনি বলেন,আমাদের শিক্ষকদের মাসিক বেতন ১৭৯ টাকা প্রদান করা রীতিমত মৌলিক অধিকার লংঘনের সামিল। দেশ স্বাধীনের পর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকরাও যে বেতন পেতেন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও একই বেতন পেতেন। অথচ আমাদের বেতন সেই মান্ধাতা আমলের রয়ে গেছে। এছাড়া সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার অনুমোদন দিয়েছে। তবে প্রাচীণ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা কেন ?
বাংলাদেশ সংস্কৃত-পালি কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকার স্বামীবাগ বীণাপাণি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিষ সরকার বলেন,আমরা দেশের এ রকম ২২৭টি কলেজের শিক্ষক-বর্মচারী যুগ যুগ ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছি। একটি বেতন স্কেলের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনেক দৌড়-ঝাপ পেড়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই যতদিন স্কেল দেওয়া না হয় ততদিন শিক্ষকদের অন্তত একটি সম্মানজনক ভাতা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের উপ-সচিব অসিম কুমার চৌধুরী বলেন,ব্রিটিশ আমল থেকে এই শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। বাংলাদেশ আমলে অন্যান্য বোর্ডের সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের স্কেল দেওয়া হয়েছে শুধু তাদের বোর্ডের শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি। ভাতা যা দেওয়া হয় তাও খুবই অসম্মানজনক। এই বোর্ডের পক্ষ থেকে ৮/৯ বছর আগে শিক্ষকদের মাসিক ভাতা অন্তত ৫ হাজার টাকা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। ২০১৭ সালে এ বোর্ডের পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান মাউশির ডিজির মাধ্যমে সংস্কৃত ও পালি কলেজের শিক্ষকদের একটি বেতন স্কেল নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ে আবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে দু:খজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত কোনোটাই দেওয়া হয়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিশেষ শাখার উপ-পরিচালক সৈয়দ মইনুল হোসেন সোমবার ডিডিএন নিউজকে বলেন,ওনাদের বিষয়টি খুবই মানবিক দাবি। তবে এটাকে যুগপোযুগি করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাউশির পরিচালক মো: বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আমি তার সদস্য সচিব। তিনি আরো জানান, আপাতত ওইসব শিক্ষকদের একটা সম্মানজনক ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে দ্রুত কাজ চলছে।।