মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি—এ তিনটি জিনিস মানুষের কাছে মহা মূল্যবান। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। বড় হয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজন ও কর্তব্যের টানে বিদেশে বসবাস করলেও মানুষ জন্মভূমির কথা, মাতৃভূমির মায়া ভুলতে পারে না। এসবের প্রভাব প্রত্যেক মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে বিদ্যমান থাকে। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, ভালো লাগা, গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে দেশপ্রেম। ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে নবী করিম (সা.) জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে লোক দেশকে ভালোবাসে না, সে প্রকৃত ইমানদার নয়।’
ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শে ও স্বভাবচরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য নজির উজ্জ্বল। তিনি দেশমাতৃকাকে খুব ভালোবাসতেন, মক্কার কাফেরদের নির্মম নির্যাতনে যখন স্বজাতি কর্তৃক বিতাড়িত অবস্থায় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তিনি বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ সাহাবায়ে কিরামও স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তাঁরা জন্মভূমি
মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।’ (বুখারি)
স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কিছু করা গৌরবের বিষয়। দেশ ও জাতির জন্য আত্মনিবেদিত মানুষ সমাজের চোখে যেমন সম্মানিত, তেমনি আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী। নবুয়ত লাভের পর সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা স্বদেশ মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা দেশ ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে নবী করিম (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন মুসলমানদের ওপর যে ভীষণ অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছিল, তা বিস্মৃত হলেন এবং দেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন।
স্বদেশপ্রেম একধরনের পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ, যা মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বসচেতন করে তোলে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করে এবং দেশের জনগণের সেবায় উৎসাহী করে তোলে। দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের অভাব মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটায়, দেশকে যারা ভালোবাসে না, তারা চরম অকৃতজ্ঞ, তাদের দ্বারা কখনো দেশের মঙ্গল সাধিত হয় না। আর যারা অকৃতজ্ঞ তারা প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক নয়, তারা দেশদ্রোহী ও জঘন্য চরিত্রের লোক। দেশের সীমান্তরক্ষী অতন্দ্র প্রহরীদের সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এক দিন ও এক রাতের সীমান্ত পাহারা ক্রমাগত এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদত কাটানো অপেক্ষা উত্তম।’ (মুসলিম) দেশপ্রেম জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘দুটো চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না, একটি চোখ আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর একটি চোখ যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (তিরমিজি) দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে এবং দেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকবে, তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাসবাণী এবং প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা স্বদেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে, তাদের জন্য জান্নাত।’
দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা মানুষকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে পারস্পরিক সদাচরণ করতে শেখায়। দেশের মানুষের বিভিন্ন দলমত, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পরস্পরের প্রতি বিরোধ, সংঘর্ষ-সহিংসতা ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে একে অন্যের সহযোগিতা, সহানুভূতি ও পৃষ্ঠপোষকতার ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার শিষ্টাচার গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা সবার ইমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য। সর্বোপরি দেশের জনগণের যার যার ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, নৈতিক বিধি-নিষেধের যথার্থ অনুশীলন দেশবাসীকে প্রকৃত ইমানদার মানুষে পরিণত করতে পারে এবং সমাজজীবনে বয়ে আনতে পারে সন্ত্রাসমুক্ত শান্তি-সুখের সুশীতল সমীরণ।
#চলনবিলের আলো / আপন