প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনাসংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এই মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা নবীজি (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজির (সা.) জন্য রহমত কামনা করেন; হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৫৬)।
সুতরাং শাবান মাস হলো নবীজির প্রতি অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেম-ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হতে হবে সুন্নত অনুশীলনের মাধ্যমে। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘হে বত্স! যদি পারো এভাবে সকাল ও সন্ধ্যা পার করো যেন তোমার অন্তরে কারও প্রতি হিংসা না থাকে, তবে তাই করো।’ অতঃপর বললেন, ‘এটাই আমার সুন্নত আদর্শ, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অনুসরণ করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসল; যে আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ ” (মিশকাতুল মাসাবিহ, তিরমিজি শরিফ: ৩৬: ১৭৫)।
শাবান মাসটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ একটি মাস। আরবিতে এই মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান মাস। ‘শাবান’ শব্দের অর্থ দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ এবং সংশোধন বা সুশৃঙ্খলা ও ফ্যাসাদ বা বিশৃঙ্খলা। শাবান মানে দুটি শাখা বা সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ। বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এ যেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। যেমন দুটি শাখা ভিন্ন হলেও একই কাণ্ড মূলে মিলিত; হাতের পঞ্চ আঙুল ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই সঙ্গে কাজ করে। অর্থাৎ ভিন্নতায়ও ঐক্য। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এই মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী, তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর রহ.)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত, নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ আদায় করতেন। রজব আল্লাহ তাআলার মাস, শাবান নবীজির (সা.) মাস; রমজান হলো উম্মতের মাস। রজব মাস হলো ইবাদতের মাধ্যমে মনের ভূমি কর্ষণের জন্য, শাবান মাস হলো আরও বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মনের জমিতে বীজ বপনের জন্য; রমজান হলো সর্বাধিক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে সফলতার ফসল তোলার জন্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.) রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান’। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. , প্রথম খণ্ড: ২৫৯, বায়হাকি, শুআবুল ইমান,৩: ৩৭৫)।
এই শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত বা রজনী আর বরাত মানে মুক্তি; সুতরাং শবে বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’ আরবিতে হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কোরআনুল করিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘উজ্জ্বল কিতাবের শপথ! নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এ উভয়ের মাঝে যা আছে, সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও, তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সে দিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-১০)। অনেক মুফাসসিরিন বলেন, এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসের পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।
শাবান মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ-খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়।
সাধারণত প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা রয়েছে। মাসের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদের নফল রোজা রয়েছে। মাসের পয়লা তারিখ, ১০ তারিখ, ২০ তারিখ এবং ২৯ ও ৩০ তারিখ রয়েছে নফল রোজা। এ ছাড়া নফল ইবাদতের জন্য কোনো সময় ও দিন-তারিখ নির্ধারণ ছাড়া যত বেশি সম্ভব, তা করা যায় এবং তা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে সযত্ন সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনো ফরজ-ওয়াজিব ছুটে না যায়। রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা বিশেষ জরুরি সুন্নত আমল। হাদিস শরিফে নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ, আলবানি, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১০৩)।
#চলনবিলের আলো / আপন