বর্ণমালা শিখতে বসেছে ছোট্টমণি ছড়া। মা বইটা মেলে ধরেন ছড়ার সামনে। আদর্শলিপি। বইয়ের পাতায় পাতায় রঙিন ছবি অবাক চোখে দেখে ছড়া।
ছড়ার মন নেই পড়ায়।
‘অ-তে অজগর, আ-তে আম’ এমন সাদামাটা পড়াও কিছুতেই শেখানো যাচ্ছে না তাকে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাঁপিয়ে পড়েন আম্মু।
সহসা দাদুভাই তাঁর ঘরে থেকে বেড়িয়ে এসে দেখেন ছড়া মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সামনে বই নিয়ে।
‘কিগো বৌমা! ছড়া দাদুভাই বর্ণমালা শিখছে বুঝি?’
‘চেষ্টা তো করছি শেখানোর। কিন্তু একদম আগাচ্ছে না পড়া, আব্বা।’
‘কোনও ব্যাপার না। মায়ের ভাষা তো, চেষ্টা করতে থাকো এমনিই শিখে নেবে। দেখি আমাকে দাওতো একবার।’
‘নিন আব্বা, আপনি চেষ্টা করে দেখুনতো একটু…’
দাদুভাই আদর্শলিপি হাতে নিলেন। বয়সের ভারে চোখে ভালো করে দেখতে পান না। তবু চশমাটা চোখে দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টান।
‘দাদুমণি। পড়ো তো আমার সাথে, অ আ ই ঈ!’
‘আমি তো এগুলো পারি দাদুভাই।’
‘আবার পড়ো। পড়ার সময় অক্ষর গুলিতে হাত বুলাও পরম মমতায়।’
ছড়ামণি আগেও পড়েছে বর্ণমালা। তবু আজ কেমন যেন লাগছে ওর। একটা অন্যরকম অনুভূতি।
ছড়ামণিকে পড়াতে গিয়ে দাদুভাই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। অনেক স্মৃতির ডালা ভিড় করেছে মনে। বইয়ের একেকটা অক্ষর যেন একেকটা ইতিহাস।
দাদুভাই বলেন, ‘এই যে তুমি বর্ণমালা পড়ছো। এগুলো হৃদয়ে গেঁথে নেবে। এই বর্ণমালার ইতিহাস জানতে হবে তোমায়। এ যে রক্ত ও ভালোবাসার দামে কেনা একেকটা অক্ষর।’
দাদুভাই ছড়াকে কোলে নিয়ে শুরু করেন গল্প। যে গল্পের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক অনন্য গল্প। বাঙালির ইতিহাসের এক হার না মানা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের গল্প। মাথানত না করার এক অনন্য ইতিহাসের গল্প।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় শাসন মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে উর্দু ভাষা।
মন ব্যথিত হয়ে ওঠে আবদুস সালামের। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় এসেছেন তিনি। পড়ালেখার বড় শখ ছিল। অভাবের তাড়নায় মেট্রিক ফাইনালটা দেওয়া হলো না। শিক্ষার চেয়ে পেট বাঁচানো আগে জরুরী। ছোটখাটো একটা চাকরিতে আয়েশ না হোক, পরিবারের খরচটাতো জুটবে। এই ক’দিন আগে গ্রাম থেকে ঘুরে এলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মা নিজের হাতে পাত্রী পছন্দ করছেন। সামনের শীতে বিয়ে হবে। কাজের ফাঁকে সালামের বড় ভাল লাগে এসব ভাবতে।
মানিকগঞ্জের রফিক উদ্দিনের গল্পটা অন্যরকম। জগন্নাথ কলেজে পড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে প্রেসের ব্যবসা শুরু দিয়েছেন। অনেকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এই প্রেসে আদর্শলিপি ছাপান তিনি। প্রতিটা অক্ষর ছাপানোর সময় গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখেন। একদিন এই ভাষা ব্যবহারের ওপর শাসকের বাধার কালো হাত থাকবে না। সে হাত ভেঙ্গে দিতে হবে। মায়ের ভাষার ওপর কারো খবরদারি চলবে না। তাই তো ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন রফিক উদ্দিন।
ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বারের পড়ালেখা একদমই আগায় নি। একদম ছেলেবেলায় ঘর পালিয়ে বার্মা অর্থাৎ মিয়ানমার পাড়ি জমান। এক যুগ পরবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরেন তিনি। জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে সংসারী হলেন। একটা ফুটফুটে পুত্রসন্তান এলো ঘর আলো করে। এতটুকু পুতুলের মত একটা মানুষ! আব্দুল জব্বারের বুকটা মায়ায় ভরে যায় ছেলেকে কোলে নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান। চার মাস বয়সী দুধের সন্তানের কথা ভেবে বুকে অনবরত রক্তক্ষরণ হয় তাঁর।
সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আবুল বরকত বরাবরই পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমালেন তিনি। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অত্যন্ত মেধাবী বরকতকে আলোড়িত করলো ভাষা আন্দোলন। ভাষার টান যে প্রাণের প্রতি স্পন্দনে। আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ছাত্র জনতার সাথে মিছিলে নেমে পড়লেন বরকত। ভাষার দাবী যে সবার আগে!
বায়ান্নর উত্তাল দুপুর
আট-ই ফাল্গুন, ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ। সকাল এগারোটা থেকেই শিক্ষার্থীদের সমাবেশ শুরু। সমগ্র বাংলা আজ উত্তাল। ভাষার প্রশ্নে কোনও ছাড় নয়। রক্ত ঢেলে দেবো রাজপথে, তবুও উর্দুকে মেনে নেবো না। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষকদের সাথে নিয়ে অনুরোধ করেন ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য। কিন্তু আজ তো থেমে যাবার দিন নয়। ঢাকার রাজপথ কেঁপে উঠেছে চেতনার উচ্ছ্বাসে। শত বছরের শোষণের জবাবে আজ জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ফসল। সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার। বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা এগিয়ে যাচ্ছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় উজ্জ্বল একেকটা মুখ। তাতে নেই কোন ভয়, দ্বিধা, সংকোচ। মৃত্যুর ভয় যার নেই তাকে ঠেকাবে সাধ্য কার? বিপ্লবের স্ফূরণ মিছিলের প্রাণে। সমুদ্রে মতো গভীরতা আজ জনতার ঢলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সন্নিকটে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিল। পাক শাসক গোষ্ঠী পেশিশক্তির নির্লজ্জ প্রদর্শনীর মহড়া বসালো। হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলিশ অস্ত্র হাতে নিরীহ ছাত্রদের ওপর। কিন্তু আজ তো প্রাণ দেবে বলেই মিছিলে নেমেছে ছাত্র – জনতা। নির্লজ্জ দানবের মুহুর্মূহু গুলিবর্ষণে কেঁপে ওঠে রাজপথ।
ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেল প্রাঙ্গনে অবস্থানরত রফিকউদ্দিনের মাথায় একটি গুলি এসে লাগে। সেই গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায় বীর তরুণ রফিকের। যে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আদর্শলিপি প্রকাশ করতেন গভীর মমতায় তাতে আজ নেই প্রাণের স্পন্দন। মেডিকেলের বারান্দায় পড়ে থাকে বাংলার প্রথম ভাষা শহীদের নিথর দেহ।
মিছিলের অগ্রভাগে থাকা সালামের বুকে এসে বিঁধে পুলিশের গুলি। ভাষার দাবীতে স্লোগান দিতে থাকা সালাম লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তাজা রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। সংসার আর করা হলো না জনমদুখী সালামের। ভাষার অধিকার রক্ষার মহৎ দাবীতে প্রাণ দিলেন তিনি।
জব্বার শাশুড়িকে হাসপাতালে রেখে ছাত্রদের সাথে নেমে এসেছিলেন মিছিলে। দানবের নিষ্ঠুর গুলিতে রক্তে ভেসে যায় জব্বারের দেহ। চার মাসের শিশু সন্তানকে রেখে যেই হাসপাতালে শাশুড়ির চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, সেই হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জব্বার।
মেধাবী ছাত্র আবুল বরকত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বজ্রকণ্ঠের স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিলেন মিছিলের অগ্রপ্রান্ত। পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষে একটি গুলি ছুটে এসে আঘাত করে বরকতের তলপেটে। সুঠামদেহী উচ্ছ্বল বরকতের পরনের নীল হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট ভেসে যায় রক্তে। দু’তিনজন ধরাধরি করে বরকতকে কাঁধে তুলে জরুরী বিভাগের দিকে দৌঁড়াতে থাকেন। ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বরকতকে বাঁচাতে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাসপাতালের বিছানা। বহুকষ্টে বরকত একবার মুখ তুলে বলেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি বোধহয় বাঁচবো না ডাক্তার! আপনার কাছে অনুরোধ রইলো, মাকে পৌঁছে দেবেন আমার খবর। তাঁর ছেলে আজ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হলো।’
যে বরকত ঝড় তুলতেন মিছিল-মিটিঙে, যাঁর ডাকে জোয়ার উঠতো আন্দোলনে, তিনি আজ প্রাণহীন পড়ে রইলেন রক্তের সাগরে। সাতাশ বছরের টগবগে তরুণ বরকত শহীদ হলেন মাতৃভাষার আন্দোলনে।
আরেক দুঃসাহসী তরুণ শফিউর সাইকেলে করে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয় তাঁকে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শফিউরের মেয়ে শাহনাজের বয়স মাত্র তিন বছর। তিনি মৃত্যুশয্যায় আকুতি করেন ভাইয়ের কাছে, ‘আমার মেয়েকে দেখে রেখো তোমরা। আমার যে আর কখনো ফেরা হবে না তার কাছে!’
শফিউরের মৃত্যুর তিন মাস পর জন্মগ্রহণ করে তাঁর ছেলে শফিকুর রহমান। বাবাকে কোনদিন দেখা হয়নি তার। কিন্তু যে ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন বাবা, সেই ভাষায় চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হবে তাঁর নাম।
এই নির্মম আগ্রাসনের শিকার কেবল ছাত্রজনতাই হয়নি। সেদিন ঢাকার রাজপথ অহিউল্লাহ নামের এক নয় বছরের শিশুর রক্তেও রঞ্জিত হয়েছিলো। রাজমিস্ত্রীর সন্তান নাবালক অহিউল্লাহর নবাবপুর রোডের সামনে মাথায় গুলি লাগে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে এই ক্ষুদে বিপ্লবী। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলো এক দুঃসাহসী শিশুর নাম। রক্ত ও ভালবাসার বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার যে অনন্য ইতিহাস তাতো কোনদিন ম্লান হবার নয়।
ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। দাদুভাই ছড়ামণিকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। শ্বাস নেয় বুকভরে ভোরের নির্মল বাতাসে। দূর থেকে ভেসে আসছে একুশের গান।
ততক্ষণে ফুলের তোড়া হাতে ছড়ামণির আব্বু এসে দাড়িয়েছেন বারান্দায়। তিনি ছড়ামণিকে কোলে নিয়ে দাদুভাইকে সাথে করে বেরিয়ে পড়েন প্রভাতফেরিতে। উদোম পায়ে নেমে এসেছে অজস্র মানুষ। দলে দলে এগিয়ে যায় তারা শহীদ মিনারের পথে, ভাষা শহীদদের স্মরণে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
বাতাসে ভেসে আসছে সুমধুর কণ্ঠে সংগীত-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি…
#চলনবিলের আলো / আপন