যশোরের অভয়নগর উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ১৫/১৬ বছর আগেও ভৈরব নদের বিভিন্ন পয়েন্টে নোঙর করা থাকতো সারি সারি ট্রলার। সেসব ট্রলার থেকে মাটি নামানোর কাজে ব্যস্ত থাকতো অনেকে।
আবার কেউ কেউ ব্যস্ত থাকতো সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন প্রকারের জিনিষপত্র ট্রলারে উঠাতে। আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের জন্য বিখ্যাত ছিল উপজেলার দেয়াপাড়াসহ অনেক গ্রামে মাটির তৈরি জিনিষপত্র। কিন্তু সময়ের দাপটে প্লাস্টিক ও সিলভারের তৈরি জিনিষপত্রের কাছে হার মেনেছে মাটির তৈরি জিনিষপত্র। চাহিদা না থাকায় উপজেলায় এখন নামেমাত্র টিকে আছে এই শিল্পটি। সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলার চলিশিয়া গ্রামের কুমারদের হাতে তৈরি মাটির জিনিস পত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। স্থানীয় চাহিদা মটিয়ে বিভিন্ন উপজেলার হাট বাজারেও পাওয়া যেত এই মৃৎশিল্প। বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমাররা এ পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ছিল মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্পীরা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন, ঢাকনা, কলসি, ছোট বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রীসহ প্রভৃতি তৈরি করত। তাঁদের তৈরি পুতুল বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু নানা প্রতিকূতায় মৃৎশিল্প বিপন্ন হতে না হতেই ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এই মাটির তৈরি শিল্প। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতা
উপজেলায় এখন মাত্র শ’ খানেক পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন বিষয়টি জানান, অভয়নগর উপজেলার শ্রীধরপুর ইউনিয়নের দেয়াপাড়া গ্রামের পালপাড়া এলাকার গোপাল পাল (৫৮)। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখার সুযোগ পাননি তিনি। এছাড়া বাপ-দাদার পেশার প্রতি দরদ থাকায় এ পেশাতেই কেটে গেছে জীবন। তবে তার ঘরে জন্ম নেওয়া দুই ছেলে সন্তানের কেউই এ পেশায় নেই বলে জানান তিনি। উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নের পালবাড়ি এলাকার অর্চনা পাল বলেন, প্লাস্টিকের যুগে এখন আর মাটির জিনিসের তেমন গুরুত্ব নেই বাজারে বা মানুষের কাছে। আমরা মাটি দিয়ে যেসব জিনিস বানায়, সেগুলো আর আগের মত বেচতে পারিনা।
ছেলের বউদের নিয়ে অবসর সময় কাটানোর জন্য কোন রকমে নামেমাত্র ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার পেশাটি। তবে উপজেলার সিদ্দিপাশার, ধুলগা , বাঘুটিয়া, মধ্যপুর, নওয়াপাড়া এলাকার পালপাড়ার কয়েক হাজার পরিবারের অর্থ উপার্জন করার অন্যতম মাধ্যম ছিল ওই মৃৎ শিল্প। মাটির হাঁড়ি, ঢাকনা, বদনা, পানির চার, ফুলের টব ও চালের জালাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের জিনিষপত্রাদি তৈরি করতেন ওই মৃত শিল্পীরা। আশপাশের উপজেলাগুলোতে তাদের তৈরিকৃত মাটির জিনিষপত্রের চাহিদা ও সুনাম ছিল। উপজেলার উত্তর দেয়াপাড়া পালপাড়া এলাকার মৃত হরিপদ পালের ছেলে হারান পাল জানান, এখন আর আগের মতো মাটির তৈরি জিনিষপত্রের চাহিদা নেই। শুধু অর্ডার পাওয়া দইয়ের পাতিল তৈরি করে তারা তাদের ওই পেশাটি কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে তার ছেলে এবং ভাতিজারা কেউই আর এই পেশায় নেই ও ওই এলাকা থেকে অনেকে আবার ভারত চলে গেছে বলেও জানান তিনি। উপজেলা প্রশাসন ও সামাজিক রাজনৈতিক ভাবে মাটির তৈরি বিলুপ্তির পথে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দাবি করেছেন সচেতন মহল। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়দেব চক্রবর্তী জানান, মৃৎ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য মৃৎ শিল্পীদের উপজেলা প্রশাসন থেকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতায় করা হয়ে থাকে।এছাড়া তাদের যদি নির্দিষ্ট কোন দাবি দাওয়া থাকে সেগুলো লিখিতভাবে অবহিত করা হলে পরবর্তীতে সেই ব্যাপারে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।