বর্তমান সমাজে ব্যবসাবাণিজ্য ও জীবন পরিচালনা করতে গেলে একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে ঋণ (বিনিয়োগ) আদান-প্রদান করা। পবিত্র কুরআন-হাদিসে একদিকে ঋণ প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে, অপরদিকে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা নিয়ে যেমন উপকৃত হয় এবং তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, তেমনি ঋণদাতাও এর মধ্য দিয়ে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং সওয়াবের অধিকারী হয়। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করবে তাদের জন্য উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব
১. ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সূরা নিসার ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে। আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এমনকি তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যেন মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টন হয়। ২. রাসূল সা: তাঁর সাথীদের নামাজে জানাজা পড়াতেন না যদি না তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা থাকত (বুখারি : ২১৪৮ ইফা)। ৩. হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লহ সা: বলেছেন, ‘যে লোক তিনটি বিষয়ে অর্থাৎ অহঙ্কার, গণিমতের সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা গেল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি : ১৫৭২; ইবনে মাজাহ : ২৪১২) ৪. হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম লোক, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে’ (সহিহ বুখারি : ২২৩২ ইফা)। ৫. হজরত আবদুুল্লহ ইবনে অমর ইবনে আস রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লহ সা: বলেছেন, ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (সহিহ মুসলিম : ৪৭৭৭)। ৬. হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লহ সা: বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হয়’ (ইবনে মাজাহ : ২৪১৩; তিরমিজি : ১০৭৮, ১০৭৯)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মদ ইবনে জাহাশ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লহ সা:-এর কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি আকাশের দিকে তাঁর মাথা উঠান, তারপর তাঁর হাত ললাটের ওপর স্থাপন করে বলেন, সুবহানাল্লহ! কী কঠোরতা অবতীর্ণ হলো! আমরা ভয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। পরদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! ওই কঠোরতা কী ছিল, যা অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ তাঁর কসম! যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, আবার জীবন লাভ করে; আবার শহীদ হয় এবং আবার জীবিত হয়, পরে আবার শহীদ হয়, আর তার ওপর ঋণ বা কর্জ থাকে, তবে তার পক্ষ থেকে সে ঋণ বা কর্জ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সুনানে নাসাঈ : ৪৬৮৪ ইফা)।
৭. হজরত আবু কাতাদাহ রা: বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি মনে করেন, যদি আমি আল্লাহর পথে অগ্রগামী অবস্থায় পশ্চাৎপদ না হয়ে সওয়াবের আশায় দৃঢ়পদ থেকে শহীদ হই, তাহলে আল্লাহ আমার সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন কি? তখন রাসূলুল্লাহ বললেন‘হ্যাঁ, যদি তুমি ধৈর্য ধারণকারী সওয়াবের আশায় আশান্বিত হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে শত্রুর মুখোমুখি অবস্থায় নিহত হও, অবশ্য ঋণের কথা আলাদা। কেননা জিবরাঈল আ: আমাকে এ কথা বলেছেন।’ (সহিহ মুসলিম : ৪৭৭৪) ৮. ইবনে মাসুদ রা: থেকে বর্ণিত নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে (মিথ্যা) কসম করবে (কিয়ামতের দিন) সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায় যে, আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত থাকবেন।’ (সহিহ বুখারি : ২৬৭৩) ৯. সময় মতো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ঋণ পরিশোধ করে দেয়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ঋণগ্রহীতা যেন এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারে সে জন্য রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবাদের দোয়া শিখিয়েছেন। দোয়াটি হলো ‘আল্লহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা, ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক।’ অর্থ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল বিষয়ের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান এবং আপনার দয়া ও করুণা দিয়ে অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন।’ (তিরমিজি : ৩৫৬৩)।
ঋণ আদায়ে কঠোরতা আরোপ করা যায়
আমর ইবনুশ শারিদ রহ: থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ না করলে তার মান-সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ করা যায় এবং তাকে শাস্তি দেয়া যায়।’ ইবনুল মুবারক রহ: বলেন, এর অর্থ হলো তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবেন এবং তাকে আটক করা যাবে (আবু দাউদ : ৩৬২৮)। আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিলো। সাহাবায়ে কেরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন। তিনি বলেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে।’ (বুখারি : ২২৩২)
#চলনবিলের আলো / আপন