মহররম মাস আরবি হিজরি সনের প্রথম মাস। যে চার মাস সম্মানের মাস এবং যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখার মাস, সেই চার মাসের একটি হলো মহররম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না। (সুরা তওবা : ৩৬)। হাদিসে উপরোক্ত চারটি মাস বলা হয়েছে যেমন জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাস। এ মাসকে আল্লাহর মাস বলে হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রমজান মাসের পর যদি তুমি আরও কোনো রোজা রাখতে চাও, তবে মহররমের সিয়াম পালন কর। কেননা, এ মাসটি হলো আল্লাহর মাস। এতে এমন একটি দিন আছে যে দিন আল্লাহ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তওবা কবুল করেছিলেন এবং আগামীতেও তিনি আরেক সম্প্রদায়ের তওবা এ দিনে কবুল করবেন। (তিরমিজি-৭৩৯)।
মহররমের ১০ তারিখ
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, এ মাসে এমন একটি দিন আছে যাতে আল্লাহ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তওবা কবুল করেছিলেন এবং আগামীতেও তিনি আরেক সম্প্রদায়ের তওবা এই দিনে কবুল করবেন, সেই দিনটি হলোÑ মহররমের ১০ তারিখ। এ ১০ তারিখ ইসলাম ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। পৃথিবীর ধারাবাহিক ইতিহাসে এ তারিখটি অনেক তাৎপর্য বহন করে। ঘটনাবহুল এ দিবসটি সম্মানের এবং আমলের মাধ্যমে উদযাপনের দিন। এ দিনে ইতিহাসের পাতায় অনেক ঘটনা পাওয়া যায়। এ সুন্দর সুফলা, সবুজ-শ্যামল পৃথিবী মহান আল্লাহ তায়ালা এদিনেই সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এ দিনেই পৃথিবীতে অবতরণ করেন। কথিত আছে, দীর্ঘ ৩০০ বছর অবিরাম কান্নার পর এ ১০ তারিখেই তার দোয়া মহান সৃষ্টিকর্তা কবুল করে নেন। পৃথিবীর বুকে হজরত হাওয়া (আ.) কেও আল্লাহ তায়ালা পাঠালেন। তবে হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) মিলিত হলেন আরাফার ময়দানে এ মহররম মাসের ১০ তারিখেই। হজরত নুহ (আ.) এর কিশতি জমিনে অবতরণ করে এ ১০ তারিখে। হজরত ইবরাহিম (আ.) দীর্ঘ ৪০ দিন নমরুদের অগ্নিকু-লীতে থেকে এ ১০ তারিখেই মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব (আ.) রোগ থেকে সুস্থ হন। হজরত ইয়াকুব (আ.) নিজের হারানো চক্ষু ফিরে পান এবং হজরত ইউসুফ (আ.) কে ফিরে পান দীর্ঘ ৪০ বছর পর। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে এ ১০ তারিখে মুক্তি পান। হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে নদী পার হয়ে মুক্তি পান আর ফেরাউন এ দিনে নদীতে নিমজ্জিত হয়ে মারা যায়। হজরত ঈসা (আ.) কে আসমানে এ দিনই উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতায় স্পষ্ট হয় যে, এদিনটি ইসলামের বিজয়ের দিন। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের দিন। অনেক সম্প্রদায়ের মুক্তির দিন। সব মঙ্গলময় ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়েছিল। এ দিনেই সত্যের জয় আর মিথ্যার পরাজয় দুনিয়ার সব মানুষের সামনে স্পষ্ট উজ্জ্বল হয়েছিল। এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি অনুগ্রহণ ও বিশাল দান। তাই বান্দার পক্ষ থেকে তার শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত ও কর্তব্য। তাই যুগে যুগে এ দিনে বান্দারা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মহান আল্লাহকে রাজি ও খুশি করার লক্ষ্যে সিয়াম পালন করে আসছে। এ সিয়ামের ধারাবাহিকতা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও পালন করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে কোরাইশরা আশুরার রোজা রাখত। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রোজা রাখার নির্দেশ দেন। পরে রমজানে রোজা ফরজ হলে রাসুল (সা.) বলেন, যারা ইচ্ছা আশুরার রোজা রাখবে এবং যারা ইচ্ছা রাখবে না। (বোখারি-১৭৭২, মুসলিম-২৫০৩)।
মহররমের রোজার হুকুম
মহররম মাস এবং মহররমের ১০ তারিখ গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি দিন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাতে রোজা রাখার কথা বলেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এ দিন রোজা রেখেছেন এবং আমাদের রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বোখারি-১৮৭৮, মুসলিম-২৫২৪)।
সালমা ইবনে আকওয়া (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিন গোত্রের এক ব্যক্তিকে লোকদের মধ্যে ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন, যে ব্যক্তি রোজা রাখেনি, সে যেন রোজা রাখে আর যে ব্যক্তি আহার করেছে, সে যেন রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করে। অর্থাৎ দিনের বাকি অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকে। (মুসলিম-২৫৩৪)।
মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে ফরজ ছিল। যখন দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়, তখন আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কোরাইশরা আশুরার সাওম পালন করত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)ও এ সাওম পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন, তখনও এ সাওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দিন। যখন রমজানের সাওম ফরজ করা হলো তখন আশুরার সাওম ছেড়ে দেওয়া হলো, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। (বোখারি-১৮৭৬)। এতে স্পষ্ট হয় যে, পরে আশুরার রোজা পালন করা সুন্নত। ওয়াজিব বা ফরজ নয়।
আশুরার রোজা কয়টি এবং কখন
আশুরার রোজা অধিকাংশের মত হলো দুটি রোজা রাখবে। এ মতের ওপর ফতোয়া। অর্থাৎ আশুরা উপলক্ষে দুটি রোজা রাখবে। আর এ দুটি ১০ তারিখের আগে একটি অথবা পরে একটি সংযুক্ত করে দুটি রোজা রাখবে এবং দুটি রোজা রাখাই সুন্নত। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনের রোজা রাখলেন এবং সাহাবাদের রোজা রাখার জন্য আদেশ করলেন, তখন সাহাবিরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটা এমন একটি দিনÑ যাকে ইহুদি ও নাসারারা সম্মান প্রদর্শন করে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যদি আমি আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে অবশ্যই নবম তারিখেও রোজা রাখব। (মুসলিম-২৫৩২-৩৩)।
রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ কর। আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোজা রাখ। (মুসনাদে আহমাদ ১/২৪১)। এতে স্পষ্ট হয় যে, রোজা দুটি রাখবে এবং দশম তারিখে একটি এর আগে একটি অথবা পরে একটি রাখবেÑ উভয়টির এখতিয়ার রয়েছে। আর শুধু আশুরার দিন রোজা রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম মাকরুহ বলেছেন। তবে জায়েজ রয়েছে। কেউ রাখলে কোনো সমস্যা হবে না।
আশুরার রোজা রাখার কারণ ও তার ফজিলত ইবনে আব্বাস (রা.)।
#চলনবিলের আলো / আপন