সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পূর্বাহ্ন

ই-পেপার

বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে পাওয়ার প্লান্ট উদ্ভাবন করলো আগৈলঝাড়ার কৃতি সন্তান সাহান

রুবিনা আজাদ,আঞ্চলিক প্রতিনিধি,বরিশাল:
আপডেট সময়: বুধবার, ৯ জুন, ২০২১, ২:৪৮ অপরাহ্ণ

** প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সরকারের সাশ্রয় হবে ২ কোটি টাকা
** দুই কিলোমিটার সড়কে ১৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব

বরিশালের আগৈলঝাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে এন্ড পাওয়ার প্লান্ট উদ্বাবন করেছে কলেজ ছাত্র মোসলেউদ্দীন সাহান। সাহান আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেকমো ডা. মোখলেছুর রহমানের ছেলে ও গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
স্মার্ট সোলার হাইওয়ে এন্ড পাওয়ার প্লান্ট উদ্ভাবন বিষয়ে সাহান বলেন, আমাদের দেশে মূলত কয়লা, পিছ ও বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মান করে। যখন কয়লা পিচ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয় তখন অবশ্যই কয়লা ও পিচ পোড়াতে হয়। কয়লা এবং পিচ যখন পোড়ানো হয় তখন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন গ্যাস যেমন-কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয় যা মোটেও পরিবেশ বান্ধব নয়। যে জ্বালানি দিয়ে কয়লা ও পিচ পোড়ানো হয় তাতে যদি সালফারের যৌগ থাকে তাহলে তা পরিবেশের জন্য এ্যাসিড বৃষ্টি সৃষ্টিকারী গ্যাস যেমন-সালফার ডাই অক্সাইড, সালফার ট্রাই অক্সাইড উৎপন্ন করে যা মোটেও পরিবেশ বান্ধব নয়। কিন্তু এ স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করতে এরকম পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোন ধরনের পদার্থ ব্যবহার করা হয় না।

সাহান ২০১৬ সালে সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় স্মার্ট সোলার হাইওয়ে এন্ড পাওয়ার প্লান্ট প্রজেক্টের কাজ শুরু করে ২০১৭ সালে প্রজেক্টের কাজ শেষ করে। সাহান ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ এবং ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মাহিলাড়া ডিগ্রী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পয়েন্ট নিয়ে পাশ করে।
২০১৫ সালে উপজেলা পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করে সাহান । ২০১৭ সালে উপজেলা, জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান, জাতীয় পর্যায় বছরের সেরা মেধাবী নির্বাচিত হয়ে পদক প্রাপ্ত হয়। ২০১৯ সালে উপজেলা, বরিশাল মহানগর ও বিভাগ পর্যায় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থা এবং জাতীয় পর্যায় বছরের সেরা মেধাবী নির্বাচিত হয়। ২০১৭ সালে ৩৮তম জতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান দখল করে সাহান। ২০১৭ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় উপজেলা ও জেলা পর্যায় ১ম স্থান অধিকার করে। ২০১৮ সালে জাপান সরকারের আমন্ত্রনে সাকুরা সাইন্স একসেন্স প্রগ্রামে ৮দিনের জন্য অংশগ্রহন করে সাহান।

উদ্ভাবক সাহান জানায়, রাস্তা তৈরি করতে ন্যানোটেকনোলজি দ্বারা তৈরিকৃত সোলার সেল ব্যবহার করা হয় যা মূলত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। তাছাড়া স্মার্ট সোলার হাইওয়ে হচ্ছে একটি “পরিবেশ বান্ধব এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস”। এই রাস্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এটা যে কোন মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। তাছাড়া এই রাস্তা তিনটি উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। সূর্যের আলোর মাধ্যমে, মানুষের চলাচলের সময় যে ঘর্ষণ উৎপন্ন হয় সে ঘর্ষণের মাধ্যমে এবং মানুষের ও গাড়ির প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে। শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুসারে শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই কিন্তু শক্তিকে একরূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন করা সম্ভব। সে অনুসারে প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। এই রাস্তা প্রাথমিক অবস্থায় ৩০ টন পর্যন্ত চাপ নিতে সক্ষম। আর সোলার হাইওয়ে দিয়ে যখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তখন মানুষের তড়িৎপৃষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ এখানে সেমি পারমিত্রবেল ম্যাট্রিক্স টেকনোলজি, পলিক্লিস্টালিন টেকনোলজি এবং পলিকার্বনেট টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে যে কারনে ঘর্ষণের সময় যে ইলেকট্রনের যে ক্ষয় হয় তা দ্বারা মানুষের তড়িৎপৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই রাস্তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে এই রাস্তা দ্বারা সূর্যের আলোর মাধ্যমে ২ কিঃ মিঃ রাস্তা দ্বারা ৬,৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব এবং মানুষের চলাচলের মাধ্যমে ও গাড়ির প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে পিজো ইলেক্ট্রিক এফেক্ট এর মাধ্যমে আলাদা ভাবে আরও বছরে ১৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও সম্ভব। প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে রাস্তার উপর দিয়ে কি পরিমাণে গাড়ি চলাচল করছে এবং কি পরিমানে প্রেসার পড়ছে তার উপর।

সাহান আরও জানায়, আমরা যদি এ-স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করি তাহলে একই রাস্তা থেকে একই সময়ে আমরা ৩ উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করতে পারবো এবং রাস্তা হিসেবেও আমরা ব্যবহার করতে পারবো। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে সরকার প্রতি এক কিলোমিটার রাস্তার জন্য ৬ কোটি টাকা খরচ করে কিন্তু স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করতে ৪ কোটি টাকাই যথেষ্ট প্রতি কিলোমিটারের জন্য। তাছাড়া দেখা যায় যে পিচের রাস্তার যে স্থায়িত্ব তা হওয়ার কথা হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ বছর কিন্তু তার স্থায়িত্ব দেখা যায় খুব কম। কারণ বিটুমিনের সব থেকে বড় শত্রু হচ্ছে পানি। বিটুমিন যখনই পানির সংস্পর্শে আসে তখনই দেখা যায় পিচ বা কয়লার তৈরি রাস্তা ভাঙ্গতে শুরু করে। কিন্তু এ স্মার্ট সোলার হাইওয়ের এইরকম কোন ক্ষতিকারক দিক নেই। কারণ এই রাস্তা তৈরি করতে কোন ধরনের পিচ বা কয়লার ব্যবহার করা হচ্ছে না। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপায়ে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করা হয়। এই রাস্তা সাশ্রয়ী এই কারনে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতের কথাই বলছি ২০১৭ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতের জন্য বাজেট করা হয় ২১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট করা হয় ২৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাজেট করা হয় ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এখানে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিবছরই কিন্তু বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ও খনিজ খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিমান কিন্তু বেড়েই চলছে। আমি মনে করি এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করলে প্রতিবছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য সড়ক ও জনপথ খাতে আলাদাভাবে বাজেট করতে হবে না। কারণ এখানে একটা রাস্তার পেছনে সামান্য কিছু ব্যয় করে, একই রাস্তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং রাস্তা হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সরকারের ও জনগণের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে এবং প্রতিবছর আলাদা আলাদা রাস্তার জন্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের জন্য আলাদাভাবে বাজেট বরাদ্দ করতে হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর সড়কের জন্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ করা হতো সেই বাজেটের অর্থটাকে অন্যান্য খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা সম্ভব। তাছাড়া আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে খনিজ সম্পদ অর্থাৎ তেল-গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার উপরও চাপ কমবে। কারণ স্মার্ট সোলার হাইওয়েতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোন ধরনের তেল বা গ্যাস ব্যবহার করা হয় না। কারণ স্মার্ট সোলার হাইওয়েতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় “সূর্যের আলোর মাধ্যমে, মানুষের চলাচলের সময় যে ঘর্ষণ হয় সেই ঘর্ষনের মাধ্যমে এবং গাড়ির চাপকে কাজে লাগিয়ে।
স্মার্ট সোলার হাইওয়ে হচ্ছে একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং পৃথিবীতে যতদিন পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকবে এবং এই রাস্তা থাকবে ততদিন এই রাস্তার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এই রাস্তার স্থায়িত্বকাল হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ বছর।

ভবিষ্যতে এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ে আরো বেশি উন্নীতকরণ করার ইচ্ছা আছে তার যাতে করে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হয়। ভবিষ্যতে এই স্মার্ট সোলার হাইওয়েতে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ডাস্ট সেন্সরসহ আরো কিছু প্রযুক্তি যুক্ত করতে চায়। যাতে করে মানুষ আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ের আশেপাশের প্রতিটি বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে কলকারখানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি স্থানের যতগুলো ইলেকট্রিক লাইন আছে সবগুলি স্মার্ট ফোনের সাহায্যে কন্ট্রোল করা যায়। এই রাস্তাটি তৈরি করতে মোঃ মোসলেউদ্দীন সাহানের ৭০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে এই রাস্তাটি নিয়ে আরো কাজ করার ইচ্ছা আছে তার।

এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আবুল হাশেম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে এন্ড পাওয়ার প্লান্ট উদ্ভাবক কলেজ ছাত্র মোসলেউদ্দীন সাহানের এই প্রজেক্ট বাংলাদেশকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার এই প্রজেক্টকে আরও আধুনিকভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।

 

 

#চলনবিলের আলো / আপন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর